ইনসাইড ইনভেস্টিগেশন

হত্যা মামলার আসামী কাইয়ুমের স্বদেশ প্রোপার্টিজের শেয়ার কিনছেন কারান্তরীন ‘গোল্ডেন মনির’?


প্রকাশ: 13/11/2022


Thumbnail

স্বদেশ প্রোপার্টিজ লিমিটেডের বেনামি ৪০ ভাগ শেয়ারের মালিক বিদেশে পলাতক ঢাকা উত্তর বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ুম। আলোচিত ইতালি নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ড মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামী তিনি এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততাও রয়েছে। বিএনপির এই নেতা এখন লন্ডনে বসে কারাগারে থাকা ‘গোল্ডেন মনির’ নামে পরিচিত মনির হোসেনের কাছে বেনামি এই ৪০ ভাগ শেয়ার বিক্রি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যার মূল্য ১০০ কোটি টাকা। বিএনপির সঙ্গে এই ‘গোল্ডেন মনির’ এর সম্পৃক্ততার কথাও জানিয়েছিলেন র‍্যাবের কর্মকর্তারা। এখন এই হত্যা মামলার আসামী পলাতক এম এ কাইয়ুমের শেয়ার কিনছেন কারান্তরীন ‘গোল্ডেন মনির’। কিভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে, বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে ত্বরান্বিত করার একটি নীলনকশা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে।

স্বদেশ প্রোপার্টিজের বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান চৌধুরী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াকিল উদ্দিন। ওয়াকিল ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। কারাগারে থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি কোনো ব্যবসায়ীক লেনদেন করতে চায় সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি সাপেক্ষে জেলে থাকা অবস্থায় লেনদেন করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে, দুর্নীতি, চোরাচালান এবং বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ‘গোল্ডেন মনির’ কিভাবে এই শেয়ারের মালিকানা কিনছে? কাইয়ুম একজন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী। এক্ষেত্রে পলাতক থাকার কারণে তাঁর সম্পত্তি কেন এখন পর্যন্ত ক্রোক করা হয়নি?

জানা যায়, এম এ কাইয়ুম সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং লন্ডনে সম্প্রতি বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছেন। তিনি লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার ‘ডানহাত’ হিসেবেই এখন কাজ করছেন। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থপাচার করে তারেক জিয়ার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই শেয়ার বিক্রির টাকা যে লন্ডনে চলে যাবে তা মোটামুটি নিশ্চিত।

কে এই কাইয়ুম?

কাইয়ুম গুলশান-বাড্ডা এলাকার কমিশনার ছিলেন।২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়ের পর গুলশান, বাড্ডা এলাকায় জমি দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠে কাইয়ুমের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০০৪ সালে কমিশনার হওয়ার পর বাড়তে থাকে প্রভাব প্রতিপত্তি। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে এম এ কাইয়ুমের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওই সময় তিনি নিয়মিত হাওয়া ভবনে যেতেন এবং হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিলেন তিনি।

পরে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলেন আবাসন প্রতিষ্ঠান স্বদেশ প্রোপার্টিজ। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে গুলশান-বাড্ডা আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন কাইয়ুম। একাদশ সংসদ নির্বাচনে কাইয়ুমের আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় তার স্ত্রী শামীম আরাকে। ‘নাভিদ উল ওয়ারস’ নামে একটি গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী।


বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়েছিলেন কাইয়ুম। আবাসন ব্যবসা ছাড়াও মালয়েশিয়ায় তার অঢেল অর্থকড়ি আছে।

২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালি নাগরিক তাবেলা সিজারকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে নাম আসে ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত কাইয়ুমের। পরে তদন্তে কাইয়ুমের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। আলোচিত ইতালি নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ড মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামী তিনি। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজারকে হত্যা করে। এম এ মতিনকে অর্থের যোগানদাতা এবং এম এ কাইয়ুম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ব্যক্তি। এরপর কাইয়ুম দেশ থেকে পালিয়ে পরিবারসহ মালয়েশিয়ায় যান। সেখান তিনি লন্ডনে যান এবং তিনি এখন তারেক জিয়ার ‘ডানহাত’ হিসেবে কাজ করছেন।

কে এই ‘গোল্ডেন মনির’?

২০২০ সালের ২১ নভেম্বর রাতভর অভিযান চালিয়ে সকালে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে ‘গোল্ডেন মনির’ নামে পরিচিত মনির হোসেনকে। র‍্যাবের অভিযানে ‘গোল্ডেন মনির’ নামে পরিচিত কথিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনির হোসেনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, চার লিটার মদ, ৮ কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি।

র‍্যাবের সূত্রে জানা যায়, কার্যত সোনা চোরাচালানই ছিল মনিরের ব্যবসা; পরে তিনি জড়িত হন জমির ব্যবসায়। মনির ঢাকা ও আশপাশে গত ২০ বছরে ২ শতাধিক প্লটের মালিক। বাড্ডা, নিকেতন, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা, নিকুঞ্জ এলাকায় অবৈধভাবে নেওয়া ২ শতাধিক প্লট-ফ্ল্যাট তার আছে এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনির ৩৫টি প্লটের কথা স্বীকার করেছে। জমির ব্যবসায় নেমে রাজউকের বর্ধিত ভবনে একটি অফিস খুলে বসে সে, সেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। রাজউকের বিভিন্ন ধরনের তদবির, জমির কাগজ তৈরি, নকল ফাইল তৈরি করাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে থাকে।

স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসার মধ্যেই ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মনির জমির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। গোল্ডেন মনিরের উত্থান ঘটে লুৎফুজ্জামান বাবর যখন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী হয় তখন। তখন গণপূর্ত ও রাজউকের সঙ্গে তার সম্পর্ক গাঢ় হয়। সেসময় লুৎফুজ্জামান বাবরের মুল ব্যবসা ছিল চোরাচালান। সে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের দায়িত্ব মনিরকে দেয়া হয়। এখান থেকেই গোল্ডেন মনির ফুলে-ফেঁপে ওঠেন এবং বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হন। গামছা বিক্রেতা থেকে জমির ব্যবসার ‘মাফিয়া’ হয়ে ওঠেন মনির।

বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন গোল্ডেন মনির, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। তবে বিএনপিকে অর্থায়ন করা, বিভিন্ন নাশকতা তৎপরতা করা এবং অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ করা, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এই বিএনপি নেতা। গোল্ডেন মনির অবাধেই সব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরপর আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাছে খবর ছিল যে, বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় গোল্ডেন মনিরের হাত রয়েছে এবং এ প্রেক্ষিতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭