ইনসাইড থট

জন্মদিনের দিনের খোঁজে


প্রকাশ: 15/11/2022


Thumbnail

গত এক দশক ধরে হন্যে হয়ে খুঁজেছি এ পৃথিবীতে আমার জন্মের লগ্ন বা তিথিটা ঠিক কখন। পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া সিন্দুকের তলানিতে কাঠের সাথে আটকে থাকা প্রায় মুছে যাওয়া অক্ষরের দলিলপত্রও নানা সময়ে হাতিয়েছি। কিন্তু কাগজে কলমে কোথাও পাচ্ছিলাম না। যদিও স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা নিশ্চিত করে যে, আমার আগমন আর ষাটের দশকের শুরুটা প্রায় এক সঙ্গেই হয়। মাঝেমধ্যে মনের গহীনে পরিতাপ বোধ করলেও প্রয়াত মা-বাবাকে কখনও দায়ী করি না। কখনো মনে হয়, বাবার সাথে আলোচনা করেই প্রধান শিক্ষক যথার্থ দিনক্ষণ বসিয়ে দিয়েছিলেন। যা পরে  ললাট লিখন হয়ে উঠে। কারণ এসব সংরক্ষণের দায়িত্ব বাবার। তবে বাবার ভাষ্য মতে,'৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভিজে গিয়েছিল তাঁর সংরক্ষিত অসংখ্য পুরনো দলিল দস্তাবেজ। এতে নাকি হাতের লিখা একটা খাতাও ছিল। পরবর্তী কালে জমির দলিলপত্রের নকল জেলার রাজস্ব বিভাগের রেকর্ড রুম থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও আমাদের ভাই বোনদের জন্মক্ষণের নকল পাওয়া যায়নি। কারণ এর নকল হয়না। শুনেছি, বন্যার পানিতে যা নষ্ট হয়েছিল এর মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল জন্মতারিখের খাতাটা। আজ এত দিন পরে যা পেয়েছি তা দিয়ে আমার মন ভরে না। তথাপি মৌখিক সাক্ষ্য থেকে একটা মাহেন্দ্রক্ষণের কথা জেনে অপরিমেয় সান্ত্বনা অনুভব করে থাকি। 

২) আমাদের এক অশীতিপর ফুফা সেই কৈশোর সময় থেকেই আমাকে দেখলে জড়িয়ে ধরেন। কখনো গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, "তিথিটা আমার স্পষ্ট জানা আছে। সেদিন জুম্মাবার ছিল। বাড়ির মুরুব্বিজন সকলই মসজিদে গেছেন। আমি সদ্য বিবাহিত জামাই। তখনও বাড়ির লোকজনকে চিনে উঠতে পারিনি। তাই সেসময় তোমাদের বাড়িতেই ছিলাম। পৃথিবীতে তোমার আগমনী গানটা আমার কানে দিব্যি বেজেছিল। আজো যেন সেই চিৎকার শুনতে পাই। আমি উঠােনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম তুমি এসেছ"।

আমি ইতোমধ্যে ষাটোর্ধ হয়েছি। বিস্ময়কর!  সেই ফুফাও মোটামুটি সক্ষমতার সঙ্গে জীবিত। মনে হয় মানুষের স্মৃতির কোনো বয়স হয়না। স্মৃতিই নাকি মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী গুণ। তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা নেই, উপযুক্ত একাধিক সন্তান নেই। বয়সের কারনে অনেকটা ন্যুজ ভঙ্গিতে হাঁটেন, এদিক ওদিক তাকান। তবু শ্বশুরালয়ে আসতে অনেক বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বলেন, মনে রেখো শ্বশুরবাড়িতে জামাই কখনো পুরানো হয়না। ইদানিং আমার খবর পেলেই বাড়িতে চলে আসেন। আমার সাথে দেখা হয়, গল্প করেন। গর্বভরে বলেন, 'এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, আমি এ বাড়ির বড় জামাই'। তখন তাঁর চোখের কোণে টলমল করে ওঠে অশ্রু। আমি তাঁর ত্রিকালদর্শী তামাটে মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। কথা শুনি, মনোনিবেশ করি তাঁর প্রতি। শোনাও যে বক্তার কষ্ট লাঘবের একটি বড় মাধ্যম। মানুষ জন্মগত ভাবেই নিজের কথা অন্যকে শোনাতে চায়। তিনিও বলে যাচ্ছেন, শ্রোতা আমি একা এবং একজন। 

৩) এখন আপনার বাড়িতে কারা আছে? 

না বাবা, কেউ নেই। ছেলেটা বিয়ে করে দূরে থাকে। ভৈরব বাজারে ব্যবসা করে। আসে খুঁজ-খবর নেয়। নিজের পৈতৃক নিবাস ফেলে আমরা বুড়োবুড়ি সরকারি প্রকল্পে থাকি। 

এটা সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প? 

জী বাজান, ছেলে আবেদন করে পাইছে। 

ছেলের বউও সাথে থাকে। ঘরটা বেশ ভালো। 

সেখানে কোনো সমস্যা হয়না? 

সমস্যা তো আছেই। তবে আশেপাশে অন্য লোকজন থাকায় কথাবার্তা বলতে পারি। সেখানে আমার সমান বয়সী দু'চার জন মানুষও আছে। এই আর কি বাবা। কয়দিন আর থাকবো। 

ইউ এন ও সাহেবরা দেখতে আসেন? 

হ্যাঁ, কিছু দিন আগে একবার আসছিল। দেখে গেছে। আমাদের কোন অসুবিধা নাই বলে গেছেন। কপালে ছিল, নিজের বাড়ি ছাইড়া গেলাম। আমার জন্য দোয়া করো বাবা। 

এবার আমি বললাম, আমাকে এই নম্বরে ফোন দিবেন। ছেলের সাথে কথা হয়েছে, সমস্যা হলেই জানাবেন। আমি উপজেলার বড়ো  অফিসারকে বলে দিলে আপনার কাজ করে দিবেন। আল্লাহ আপনার সহায় হোন। 

৪) ভাবছিলাম, গত কয়েক বছরের নিরন্তর প্রচেষ্ঠা ও লাগাতার নজরদারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী জমিহীন, গৃহহীন মানুষের জন্য এমন উদ্যোগ না নিলে এ মানুষগুলোর ঠিকানা কোথায় হত? আশ্রয়ণ এখন দেশের হাজার হাজার অসহায় ছিন্নমূল, বাস্তুচ্যুত ও সম্বলহীন মানুষের একটা আশার আলো হয়েছে। মাথার উপরের আচ্ছাদন এমনকি সমাজবদ্ধতার মিলনক্ষেত্রও সরকার করে দিয়েছে। এর মানবিক তাৎপর্য এর সামাজিক গুরুত্ব এবং পারিবারিক জীবনাচার নিয়ে আমরা ক'জন নিবিড় সংবেদনশীলতার সঙ্গে চিন্তা করি? চারপাশে আমরা যা দেখি বাঁচার জন্য তা কী যথেষ্ট? অবশ্যই নয়।  সত্যিকারের জীবনবোধ পাঠ করার জন্য আরও বেশি কিছু দেখা প্রয়োজন। উল্লেখ করা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দারিদ্র্য বিমোচনকে টার্গেট করে কেবল মুজিব বর্ষেই ২০২১ সালের শুরুতে ৬৩ হাজার ৯৯৯টি পরিবারকে জমির মালিকানাসহ ঘর দেয়া হয়েছে। একই বছর  দ্বিতীয় পর্যায়েও প্রদান করা হয় ৫৩ হাজার ৩৩০টি গৃহহীন, জমিহীন পরিবারকে। যা এখনো পুরোদমে চলমান আছে। গ্রামীণ পথের ধারে বা নদীর তীরে গুচ্ছগুচ্ছ সারিসারি বর্ণিল ঘরগুলোর নান্দনিকতাও পথচারীদের চোখে পড়ার মতন। 

৫) কখনো কখনো ভাবি, শুক্রবার জুম্মার বেলায় আমার জন্ম হয়েছে বলেই বোধহয়, 

জুম্মার নামাজের প্রতি বরাবরই আমার প্রবল আকর্ষণ। আমি সচরাচর এ নামাজ মিস করি না। ঢাকায় শুক্রবারে নানাস্থানে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মসজিদে এ নামাজ আদায় করি। এতে আমি আনন্দ পাই। ইমামগনের বয়ানের তারতম্য বুঝতে চাই। আমার ঢাকার চল্লিশ বছরের জীবনে (যখন থাকছি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে সর্বাধিক সময় হলেও পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, ইস্কাটন, শাহবাগ,এলিফ্যান্ট রোড থেকে পান্থপথের অসংখ্য মসজিদে নামাজ পড়েছি। বলা যায়,এটা আমার এক ধরনের শখ। স্রেফ একজন সাধারণ মুসল্লীর মতন করে দাঁড়িয়ে যাই। উপভোগ করি মানুষের ধর্মাচার এবং সৃষ্টি কর্তার প্রতি আত্মসমর্পণ কৌশল। নিজের উদ্যোগে আমি দুটো মসজিদও নির্মান করেছি। একটি জেলা প্রশাসক হিসেবে নিজ কর্মস্হলে অপরটি নিজের বাড়িতে, পৈতৃক ভিটায়। সকল ধর্মেই আছে, উপসনালয়গুলো সভ্যতা বিকাশের পথে পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এগুলো প্রগতির জন্য অন্তরায় নয়। 


৬) এমনও ভাবি, জন্মদিন! কিসের জন্মদিন, কার জন্মদিন? কেন উদযাপন? নিজের জন্মদিন নিজে কেন করতে হবে? প্রয়োজন পড়লে অন্যরা করবে। গবেষণার নিমিত্ত খুঁজে বের করবে। পৃথিবীতে অনেক দিন বেঁচে থাকার অর্থ হলো সবসময় সৃষ্টিশীল কর্মযোগে থাকা। অন্যথায় কিসের থাকা? মনীষীরা বলেন, Write something worth reading or do something worth writing. মানে ভালো কিছু একটা করতে হবে। তা না হলে, থাকা বা নাথাকার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, 'তুমি যে দীর্ঘদিন বেঁচে আছ এর জন্য লজ্জিত হওয়া উচিৎ, কেননা তোমার চেয়ে অনেক কম বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অসংখ্য প্রতিভাবান। অথচ নবতিপর হয়েও তুমি পৃথিবীর কোনো কাজেই লাগােনি'। মাত্র একুশ বছর বয়সে কবি সুকান্ত আর উনচল্লিশ বছরে ওপারে চলে গিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। দীর্ঘায়ু না পেলেই কী? মানুষ তাঁদের জন্ম-মৃত্যু পালন করেই যাবে। কাজেই খামোকাই জন্মদিন খোঁজে বের করা। সবই নিরর্থক এবং বৃথা। ভাবতে হবে, পৃথিবীর সব গান আকাশ কি মনে রাখে? কাজেই তৈলাক্ত কেকের গায়ে হযবরল করে আঁকা বর্ণমালার এসব জন্মদিন কেবলই যেন মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুদিনের কথা। 

২৭ কার্তিক, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
লেখক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭