ইনসাইড গ্রাউন্ড

ফ্যাসিবাদের চাদরে আবৃত বিশ্বকাপ


প্রকাশ: 16/11/2022


Thumbnail

১৯৩৪ সাল। রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা মারপ্যাঁচে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পুরো ইউরোপ। আর এমন উত্তাল টালমাটাল সময়ে অনুষ্ঠিত হয় ফুটবল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর। ১৯৩২ সালের ৯ অক্টোবর স্টকহোমে ফিফা নির্বাহী কমিটির সভায় আয়োজক দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ইতালির নাম। ফিফার এই সিদ্ধান্তও বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়। ২৭ মে শুরু হয়ে টুর্নামেন্টের পর্দা নামে ১০ জুন।

১৯৩৪ বিশ্বকাপ ফুটবলকে তাই খালি চোখে দেখার খুব একটা সুযোগ নেই। ইতালির তৎকালীন স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি ফুটবলীয় প্রতিযোগিতার বিশ্বমঞ্চকে বেছে নেন তার ফ্যাসিবাদী দর্শন তত্ত্বের প্রদর্শনী মঞ্চ হিসেবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ইতালিকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ তো এখনো ঘুরে-ফিরে মানুষের মুখে।

তবে নানা কারণে ভিন্ন আবেদন ছিলো দ্বিতীয় ফুটবল বিশ্বকাপের। এই আসর দিয়েই বাছাইপর্বের সূচনা হয় বিশ্বকাপে। ৩২টি দল অংশ নেয় সে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে। এই আসর দিয়ে অফিসিয়াল ম্যাচ বলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩৪ বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বল হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে 'ফেদেরাল ১০২'।

দক্ষিণ আমেরিকায় বসা আগের আসরে ইউরোপের দলগুলো অংশ না নেয়ায় এবার সে মহাদেশে বিশ্বকাপ হওয়ায় লাতিন দলগুলোর অনেকেই অংশ নেয়নি ইতালি বিশ্বকাপে। আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে বিশ্বকাপ বয়কট করে। যা এখন পর্যন্ত ফুটবল ইতিহাসের বিশ্বকাপ বয়কটের একমাত্র ঘটনা। 

মোট ১৬টি দলের অংশগ্রহণ করে এই বিশ্বকাপে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ছিলো ইউরোপিয়দের আধিপত্য। ইউরোপের ১২টি, দক্ষিণ আমেরিকার ২টি, উত্তর আমেরিকার ১টি ও আফ্রিকা মহাদেশের ১টি দল অংশ নেয় সেবার। টুর্নামেন্টের ধরনেও প্রভাব পড়েছিল মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দর্শনের। যার ফলশ্রুতিতে প্রথম রাউন্ডেই নকআউট ব্যবস্থার সাথে পরিচয় ঘটে বিশ্বকাপের। প্রথমপর্বে সেবার ম্যাচের সংখ্যা ছিলো ৮টি।

২৭ জুন একইদিনে ৮টি ভিন্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ৮টি ম্যাচ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে ৭-১ গোলে ইতালি, ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে স্পেন, অস্ট্রিয়া ৩-২ গোলে ফ্রান্সকে, মিশরকে ৪-২ গোলে হারায় হাঙ্গেরি। রোমানিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে চেকোস্লোভাকিয়া, বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৫-২ গোলে জেতে হিটলারের জার্মানি। আর সুইডেনে সাথে ৩-২ গোলে হেরে বিদায় নেয় আগের আসরের রানার্সআপ আর্জেন্টিনা। সে বছর আগের বিশ্বকাপের একজন ফুটবলারও ছিলেন না আর্জেন্টিনা দলে। আগের আসরের অধিনায়ক লুইস মন্টি, রাইমুন্দো অর্সি এবং এনরিক গুয়াইতা সেবার ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ খেলেন। আর সুইজারল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে বিদায় নেয় নেদারল্যান্ডস। প্রথম পর্বে ইতালির অ্যাঞ্জেলো শিয়াভোর পা থেকে আসে সে আসরের প্রথম হ্যাটট্রিক।

গ্রুপ পর্বেই লাতিন আমেরিকার দুই দেশ ও আফ্রিকার মিসর বিদায় নেয়ায় ইতিহাসের প্রথম অল ইউরোপিয় কোয়ার্টার ফাইনাল দেখে বিশ্ব। সেখানেও জড়িয়ে আছে আরেক 'প্রথম'। ফুটবল বিশ্বকাপের প্রথম রিপ্লে ম্যাচ হয় ইতালি এবং স্পেনের মধ্যে। কোয়ার্টার-ফাইনালে দুই দলের ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হয়। শরীর নির্ভর ও আক্রমণাত্নক ফুটবল খেলে আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন স্পেনের ৭জন এবং ইতালির ৪জন ফুটবলার। পরদিন আবার ম্যাচটি মাঠে গড়ালে ১-০ গোলের জয়ে সেমি-ফাইনালে চলে যায় ইতালি। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতে অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জেতে চেকোস্লোভাকিয়া। আর এডমুন্ড কোনেনের হ্যাটট্রিকে সুইডেনকে ৫-২ গোলে হারায় জার্মানি। তবে অনেকগুলো ম্যাচের ফল জন্ম দেয় বিতর্কের।

শেষ চারের খেলায় ইতালির মুখোমুখি হয় সে সময়ের ব্যাকরণ থেকে বেরিয়ে এসে সুন্দর ও শৈল্পিক ফুটবল খেলা অস্ট্রিয়া। সে ম্যাচ শুধু দুই দলের লড়াই ছিলো না। তৎকালীন সময়ের দুই কিংবদন্তি কোচ ভিত্তরিও পোজো এবং হুগো মেইলসের লড়াইও। গুইসেপ্পে মিয়াজ্জার একমাত্র গোলে অস্ট্রিয়াকে হারিয়ে উঠে ইতালি। আর অলদ্রিচ নেদলির হ্যাটট্রিকে জার্মানদের বিদায় করে ফাইনালে চলে যায় চেকোস্লোভাকিয়া।

১০ জুন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল। রোমের স্তাদিও নাসিওনালে ফাইনাল দেখতে উপস্থিত হয় ছিলেন প্রায় ৫৫ হাজার দর্শক। ৭১ মিনিটে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন চেকোস্লোভাকিয়ার পুক। তবে ৮১ মিনিটে স্বাগতিকদের সমতায় ফেরান অরসি। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকা ম্যাচটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আর অ্যাঞ্জেলো শিয়াভোর করা অতিরিক্ত সময়ের গোলে শিরোপা জিতে নেয় ইতালি। বিশ্ব পেয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন।

৫ গোল করে সে আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন চেকোস্লোভাকিয়ার অলদ্রিচ নেদলি। জুলে রিমে ট্রফির পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন ইতালির হাতে তুলে দেয়া হয় কোপা দেল দুসে ট্রফি। যা বানানো হয়েছিল মুসোলিনির নির্দেশে এবং বিশ্বকাপ ট্রফির প্রায় ছয় গুণ বড়।

দানবীয় এই ট্রফি হয়ে উঠে প্রাচীন রোমের অহম আর ফ্যাসিবাদী ইতালির প্রতিচ্ছবি।

কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল, ইতিহাস, ইতালি, ১৯৩৪ বিশ্বকাপ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭