ইনসাইড আর্টিকেল

বায়ু দূষণে নিত্য রেকর্ড গড়ছে ঢাকা


প্রকাশ: 17/11/2022


Thumbnail

চলছে নভেম্বর মাস, শুরু হয়ে গিয়েছে শুষ্ক আবহাওয়ার মৌসুম। শীতের আগমনী বার্তা হিসেবে ভোর হতেই নগরীতে দেখা যায় হালকা কুয়াশার স্তর তবে কুয়াশার চাইতে এই স্তরে মূলত ধূলাবালি, যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া এবং বায়ু দূ্ষনের আধিক্য ই লক্ষনীয়। রাজধানীর গাবতলি, মিরপুর, উত্তরা, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্টরোড, গুলিস্থানসহ বিভিন্ন এলাকায় ধুলাবালির এই স্তর দেখে যে কেউ ভেবে বসতে পারে এই বুঝি শীতের আমেজ শুরু হলো! কুয়াশায় ঢেকে গেলো নগরী। তবে কুয়াশা ভেবে ভুল করা ঢাকানগরীর এই কুয়াশাচ্ছন্ন আবরণ মূলত ধূলার।

বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকার অবস্থান বরাবরেরমত ই প্রথম দিকে। প্রতিদিন ই গড়ছে রেকর্ড, শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসছে ঢাকার বায়ু মান মাত্রা। এবং এই রেকর্ড রাজধানী ঢাকাকে নিয়ে যাচ্ছে বিপজ্জনক অবস্থানে। মূলত মানুষের পারিপার্শ্বিক বায়ুমণ্ডলে অবাঞ্ছিত ও দূষিত পদার্থের উপস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করলে জীবজগতের যে ক্ষতি হয়, তাকেই বায়ুদূষণ বলে।

গত ১৪ নভেম্বর সকাল সোয়া নয়টার দিকে ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৫, যা বাতাসের মান অনুযায়ী ‘অস্বাস্থ্যকর’। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক বায়ুরমান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার এ তালিকা প্রকাশ করেছে। এই স্কোর অনুযায়ী বায়ুদূষনের দিক থেকে বাংলাদেশ অবস্থান করছে শীর্ষে। প্রায় প্রতিদিন ই বায়ুদূষণে শীর্ষ অবস্থান রেকর্ড করার ফলে এটি নিত্যকার চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকানগরীর।

২০১৩ সালে ‘এটমসফেরিক পলিউশন রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, অন্যান্য দূষকের তুলনায় বায়ুতে পার্টিকুলার ম্যাটারের অবস্থান স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। বায়ুতে অবস্থানকারী এই পার্টিকুলারগুলো যানবাহনের মত মানবসৃষ্ট উৎস থেকে আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। বায়ুদূষণের কারনে প্রতিনিয়ত বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুকি, যার ফলে বাড়ছে হ্রদরোগসহ আরো নানান জটিল সব রোগ। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানল রেন্সবের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলায় সংক্রমণ অথবা ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথা ব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা ও দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ছয় মাস। তবে গবেষণা বলছে, টানা দূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ অনুযায়ী বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। আর রাজধানী ঢাকায় এটি প্রায় সাত বছর সাতমাস। বায়ু দুষন কেবল স্বাস্থ্যের ই ক্ষতি করেনা বরং এটি একটি দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে ব্যাপক। বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতিহচ্ছে ১৪০০ কোটি ডলার, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি এর প্রায় ৫ শতাংশ। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিনএ য়ার এবং গ্রিনপিসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া শাখার করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া দূষিত বায়ু পশুপাখির খাদ্যকে ও দূষিত করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে বায়ু দূষণ হলে উদ্ভিদের ক্ষতি হয়। বায়ু দূষনের ফলে সৃষ্টসালফার ডাই-অক্সাইড গাছের ক্লোরোফিলের ক্ষতি করে। ফলে খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে গিয়ে উদ্ভিদের জীবনীশক্তি কমে যায়। বায়ুতে অতিমাত্রায় এ গ্যাস থাকলে পাতার কোষ মরে যায় এবং পাতা শুকিয়ে যায়। সর্বপরি বায়ু দূষণ আমাদের প্রানী ও উদ্ভিদ উভয় জগৎ এর বাস্তুসংস্থানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

 

ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণের পিছনে কিছু প্রধান কারণ রয়েছে যার মধ্যে বেশিরভাগ ই মনুষ্য সৃষ্ট কারণ। মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত বস্তু বাতাসে মিশ্রিত হচ্ছে যার ফলে ঘটছে বায়ু দূষন। যেমন- ঢাকা শহরের বিভিন্নশিল্প কারখানাগুলো থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, ধাতব কনা, ধোঁয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমানে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে। এছাড়াও বিভিন্ন যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানীর (পেট্রোল ও ডিজেল) দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনোক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এছাড়া যানবাহনের ধোয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেন অক্সাইড থাকে যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে। যানবাহনের আধিক্য বায়ূ দূষনের অন্যতম প্রধান একটি কারন। আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে নির্গত সিএফসি গ্যাস বাতাসের ওজন নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন কিংবা শিল্প কারখানা নয়, পরিবেশ আইন অমান্য করে উন্মুক্তভাবে ইট-বালি খোলা জায়গায় অথবা রাস্তার উপরেরেখে দেয়ার ফলেও বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বায়ু দূষনের জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প গুলো অধিকাংশে দায়ী। যার কারনে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ইট, বালি, সিমেন্ট, রড প্রভৃতি খোলা রেখে দেওয়া হয়েছে, যা থেকে ঘটছে বায়ু দূষন। বায়ুদূষনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধোয়া দূষণ নয়, ধুলি দূষণকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে বায়ুদূষণ রোধে সমন্বিত কর্মসূচি নিতে হবে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে সময়মত রাস্তা মেরামত না করার জন্য ও মারাত্মক ধুলি দূষণ হতে দেখা যায়। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে শহরের রাস্তাগুলো ভাল হলেও দেখা যায় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সেগুলোকে দূষণমুক্ত রাখা সম্ভব হয় না। কারন ভালো রাস্তাগুলোর উপরেও যত্রযত্র বালি, মাটি, পলিথিন বা ইটের টুকরা পড়ে থাকতে দেখা যায়। সিটি কর্পোরেশনগুলো থেকে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো আদতে কতটুকুকার্যকর?  যে পরিমান ইট-পাথর-বালি-মাটি-পলিথিন পড়ে থাকতে দেখা যায় সেগুলো শুধুমাত্র ঝাড়ু দিয়ে কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়।

বায়ু আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় একটি উপাদান। খালি চোখে দেখা না গেলেও বায়ুর অস্তিত্ব আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষনে। তাই বায়ুর গুণগত মান বজায় থাকলে কেবল মানব স্বাস্থ্যইভালো থাকে না বরংগাছের বর্ধন যথাযথভাবে হয়, কৃষি ফলন বৃদ্ধি পায়। সর্বপরি জীবজগৎ এর বসবাসের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ গড়ে উঠে। বায়ু দূষণ প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ হলো বায়ুমন্ডলে নির্গমনের পূর্বেই বায়ু দূষক উৎসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা, প্রয়োজন সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা এবং প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বায়ু দূষন রোধে কাজ করা। এতে করে শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য আমরা পাবো নির্মল ও পরিচ্ছন্ন একটি পরিবেশ।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭