ইনসাইড গ্রাউন্ড

১৯৫০ বিশ্বকাপ ও মারাকানার কান্না


প্রকাশ: 17/11/2022


Thumbnail

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে যেমন অস্থিরতায় ডুবে আছে পৃথিবী, আরেকদিকে চলছে সে ধাক্কা সামলে ঘুরে দাড়ানোর লড়াই। অক্ষ আর মিত্র শক্তির লড়াইয়ের ক্ষত চিহৃ বয়ে বেড়াচ্ছে দেশগুলো। ইউরোপসহ প্রায় পুরো পৃথিবীতেই প্রভাব পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। আর এই অস্থির সময়ে খানিকটা স্বস্তির বাতাস এনে দেয়ার উপলক্ষ্যে পরিণত হয় ১৯৫০ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এক যুগ পর আয়োজিত হয় ফুটবল ইতিহাসের চতুর্থ বিশ্বকাপ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রায় প্রতিটি দেশেরই অর্থনীতি বেকায়দায় পড়ে। এই ভেঙে পড়া আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার পুর্নগঠনে ব্যস্ত তখন সবাই। ফলে বিশ্বকাপের মত বড় প্রতিযোগিতার আয়োজক হওয়ার মত সাহস দেখাতে পারেনি অনেক দেশ। তবে ১৯৪৬ সালে ফিফা কংগ্রেসে ব্রাজিল স্বাগতিক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আবার দক্ষিণ আমেরিকায় বসে বিশ্বকাপের আসর। ১৯৫০ সালের ২৪ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত চলে মাঠের লড়াই।

তবে এ বিশ্বকাপে বদলে যায় আগের আসরগুলোর বেশকিছু ধারা। অনেকগুলো 'প্রথম' এর সাথে পরিচয় ঘটে বিশ্বকাপের। যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের চ্যালঞ্জও কম ছিলো না। স্টেডিয়াম ও কাঠামো নির্মাণের খরচ উঠিয়ে আনতে এই বিশ্বকাপে নানা নতুন পদক্ষেপ নেয়া হয়। আগের দুই আসরের শুরু থেকে যে নকআউট ব্যবস্থা ছিলো, এই বিশ্বকাপে তা উঠিয়ে নেয়া হয়। ফলে বেড়ে যায় ম্যাচসংখ্যা। বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলগুলোকে ভাগ করা হয় চারটি গ্রুপে। আগের আসরে অংশ নেয়া দলগুলোর অনেকেই এক ম্যাচ করে খেলে বিদায় নিলেও, এটিই প্রথম বিশ্বকাপ যেখানে দলগুলো খেলে অন্তত ৩টি করে ম্যাচ।

সেই সাথে ফিফা সভাপতি হিসেবে জুলে রিমের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই আসর থেকে ফুটবল বিশ্বকাপের নামকরণ করা হয় ‘জুলে রিমে বিশ্বকাপ।’ আর ১৯৭০ পর্যন্ত এই নামেই আয়োজিত হত ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই বৈশ্বিক আসর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল সামলাতে না পারায় এই বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি আর্জেন্টিনা, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরির মত বড় দলগুলি। বিশ্বকাপ খেলতে দেয়া হয়নি জার্মানিকে।

ইউরোপের ৮টি, লাতিন আমেরিকার ৫টি, উত্তর আমেরিকার ২টি ও এশিয়া থেকে ১টি দল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিলে ১৬ দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় বিশ্বকাপে। তবে পরবর্তীতে ইউরোপ থেকে স্কটল্যান্ড ও তুরস্ক, এশিয়ার থেকে ভারত নাম প্রত্যাহার করে নিলে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলের সংখ্যা দাড়ায় ১৩'তে। ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফরম্যাটেও আসে পরিবর্তন। এই বিশ্বকাপে ছিলো না কোন নকআউট। চারটি গ্রুপের মধ্যে চলে প্রথম রাউন্ডের খেলা। আর এই চার গ্রুপের গ্রুপ সেরাদের নিয়ে হয় দ্বিতীয় রাউন্ড। সেই রাউন্ডে পয়েন্ট ও গোল বিবেচনায় এগিয়ে থাকবে যে দল শিরোপা জিতবে তারাই।

ব্রাজিল, যুগোস্লাভিয়া, মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ড নিয়ে গড়া হয় 'গ্রুপ-১'। স্পেন, ইংল্যান্ড, চিলি, যুক্তরাষ্ট্র খেলে 'গ্রুপ-২' এ। আর 'গ্রুপ-৩' এ পড়ে  সুইডেন, ইতালি, প্যারাগুয়ে। লাতিন আমেরিকার দুই দল উরুগুয়ে ও বলিভিয়া ছিলো 'গ্রুপ-৪' এ। প্রথম রাউন্ডে ৩ ম্যাচে দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ-১ থেকে পরের রাউন্ডে চলে যায় স্বাগতিক ব্রাজিল। এই গ্রুপে দ্বিতীয় হয় যুগোস্লাভিয়া। সুইজারল্যান্ড তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে ছিলো মেক্সিকো। আর গ্রুপ-২ থেকে তিন ম্যাচের সবগুলো জিতে ৬ পয়েন্ট নিয়ে পরের রাউন্ডে চলে যায় স্পেন। আর গ্রুপ-৩ থেকে তিন পয়েন্ট নিয়ে ফাইনাল রাউন্ডের টিকিট পায় সুইডেন। হ্যাটট্রিক শিরোপার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসে এই গ্রুপ থেকে শুরুতেই বিদায় নেয় ইতালি। যা ছিল এই আসরের বড় অঘটনগুলোর একটি। গ্রুপ-৪-এর একমাত্র ম্যাচে বলিভিয়াকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দেয় উরুগুয়ে। সে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন দেন অস্কার মিগেল।

ফাইনাল রাউন্ডে জায়গা করে নেয়া চারটি দল ছিলো ব্রাজিল, স্পেন, সুইডেন ও উরুগুয়ে। মিনি লীগ পদ্ধতিতে চলে এই রাউন্ডের খেলা। প্রথম ম্যাচে ২-২ গোলে ড্র করে উরুগুয়ে ও স্পেন। সুইডেনকে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করে ব্রাজিল। পোল্যান্ডের উইলোভস্কির পর এই ম্যাচে চার গোলের কৃতিত্ব দেখান আদেমির দে মেনেজেস। পরের ম্যাচে স্পেনকে ৬-১ গোলে হারায় ব্রাজিল। আগের ম্যাচে ড্র করলেও সুইডেনের বিপক্ষে ৩-২ গোলের জয়ে আশা বেঁচে থাকে উরুগুয়ে। শেষ রাউন্ডে স্পেনকে ৩-১ গোলে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তিনে উঠে আসে স্পেন। আর পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ দুই দলের লড়াই পরিণত হয় অলিখিত ফাইনালে। যেখানে স্বাগতিক দলের সামনে সমীকরণ দাড়ায়, উরুগুয়ের সাথে ড্র করলেই শিরোপা জিতবে তারা।

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মারাকানা স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই প্রতিবেশী ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। আর এই শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের জন্য ব্রাজিলিয়ানরা বানিয়েছিল তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই স্টেডিয়াম। এই আসরেই ফাইনালে দর্শক উপস্থিতি ছিলো সবচেয়ে বেশি। প্রায় দুই লাখ সমর্থকের সামনে শুরু হয় শিরোপার লড়াই। গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয় ম্যাচের প্রথমার্ধ্ব। তবে বিরতির পর ৪৭ মিনিটেই দলকে এগিয়ে দেন ব্রাজিলের ফ্রিয়াকা। গোল শোধে মরিয়া উরুগুয়েকে ৬৬ মিনিটে সমতায় ফেরান হুয়ান শিয়াফিনো। আর ৭৯ মিনিটে আলসিদেস ঘিগিয়ার গোলে ম্যাচে লিড নেয় উরুগুয়ে। 

ব্রাজিলের প্রথম শিরোপার স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে ২-১ গোলের জয়ে নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতে উরুগুয়ে। কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে মারাকানায়। প্রায় ২ লাখ মানুষের কলরবের মারাকানা রূপ নেয় মৃত্যুপুরীতে। যেন সুনসান নিরবতা নেমে এসেছে সেখানে। মাটি হয়ে যায় সেলেকাওদের উৎসবের প্রস্তুতি। আর এই ট্রাজেডি "মারাকানার কান্না" নামে স্থান পায় ব্রাজিল ফুটবল ইতিহাসে।

৯ গোল করে আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ব্রাজিলের আদেমির দে মেনেজেস। টুর্নামেন্ট সেরা হন ব্রাজিলের আরেক ফুটবলার জর্জিনিয়ো



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭