ইনসাইড থট

এটা কি একটি খুব সুপরিকল্পিত, সুসংগঠিত ধীরগতির ক্রমবর্ধমান ষড়যন্ত্র?


প্রকাশ: 19/11/2022


Thumbnail

প্রতিদিনের মত, আমি সেদিন প্রথম আলো সংবাদপত্র পড়ছিলাম। যেহেতু আমি পরিস্থিতি বুঝতে এবং নিজের সিদ্ধান্তে আসতে বিভিন্ন মতামত শুনি, পড়ি আর অনুসরণ করি তাই মনোযোগ দিয়ে প্রথম আলোর আলতাফ পারভেজ-এর “চিড়া–মুড়ির রাজনীতি ও পিটার হাসের ভূরাজনীতি” শিরোনামের এই অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিবন্ধটি পড়ছিলাম। এই নিবন্ধে একটি খুব আকর্ষণীয় তথ্য প্রদান করা হয়েছে, যা পড়ে আমি মোটেও অবাক হইনি। কোন শব্দ পরিবর্তন না করেই আমি নিবন্ধের কিছু অংশ এখানে হবহু কপি করছি। “পিটার হাসের ফর্দ বড় নয়, তবে স্পর্শকাতর. গত ২৯ সেপ্টেম্বর ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ নামের এক অনুষ্ঠানে হাস পরিষ্কার করেই জানিয়েছিলেন তিনি ও তাঁর সরকার কী চাইছে। এখানে তাঁদের আপাতত চাওয়া পাঁচটি। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে’ বাংলাদেশকে নিরাপত্তাবন্ধু হিসেবে পাওয়া; গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও সুশাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন, সামাজিক ও পরিবেশগত বিপদ মোকাবিলায় সামর্থ্য বাড়ানো, শ্রম অধিকারের উন্নয়ন এবং নিরাপদে নিজ দেশে না ফেরা পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানসম্মত সুরক্ষা"। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন তার বা অন্য কথায় মার্কিন সরকারের প্রথম দাবি বা লক্ষ্য কি ছিল? এটা গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা মানবাধিকার বা সুষ্ঠু নির্বাচনের দবি নয়। প্রথম এবং প্রধান দাবি হচ্ছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে’ বাংলাদেশকে যে কোন ভাবে নিরাপত্তাবন্ধু হিসেবে পাওয়া। চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চিত করা। অন্য কথায় নানা ধরনের হুমকি বা চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করা। অন্য চারটি দাবি বা তাদের প্রচেষ্টা হল প্রথম চাহিদা অর্জনের জন্য চাপের অস্ত্র। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন সবই চাপের বিষয় এবং ফাঁকা কথা। যদি তারা সত্যই বিশ্বব্যাপী তথাকথিত নৈতিকতার কথা চিন্তা করে আর এই ধরনের মানবিক বিষয় স্থাপনে দেশগুলোর সাথে সমান অংশীদার হিসাবে কাজ করতে চাইতো তাহলে আমরা দেখতে পেতাম যে তারা সবার উপর একই রকম চাপ প্রয়োগ করছে। উদাহরণ স্বরূপ, সৌদি আরব, কাতার, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল, থাইল্যান্ডের কথা চিন্তা করুন, কোথায় সেই দাবি বা চাপ। ভেনিজুয়েলা সরকারের (পূর্বে তাদের সরকার প্রধানকে একনায়ক, দানব হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল) কাছে গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য দৌড়ে যেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি করছে। এখন আর সেখানে গণতন্ত্রের কথা নয়, বাক স্বাধীনতা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা নয়। নিষেধাজ্ঞাও চলে গেছে! এটাই হল পশ্চিমাদের দ্বৈত নৈতিকতা। পশ্চিমাদের একমাত্র এজেন্ডা হল তাদের আধিপত্য অব্যাহত রাখা। যেহেতু বাংলাদেশ এখনও “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়”, সার্বভৌম পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে, তাই বাংলাদেশ আমেরিকার দাবির চাপের কাছে মাথানত করে তাদের দাবি মানতে সম্মতি দেয়নি, বা প্রকাশ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার নিন্দা করছে না, তাই চাপ বাড়ছে। দিন দিন চাপ আরো বাড়বে। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ যদি জোটে যোগদানের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেয়, বা প্রকাশ্যে রাশিয়ার নিন্দা করে তাহলে বাকি সব দাবি ভেস্তে যাবে, নাকচ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হবে আমাদের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দাস হয়ে যাওয়া।

আপাতত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিরাপত্তা জোটে আছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান আর ভারত। এটা একটা চীন বিরোধি জোট। ঐ দেশগুলো এই জোট সম্প্রসারণ করতে চায়। আমার জাতিসংঘের কাজের সময় আমি বেশ কয়েকবার জাপানে গিয়েছিলাম। আমি টোকিওতে বহুবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিকদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি নামিবিয়াতে জাপানের রাষ্ট্রদূতের সাথে পারস্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। আমি এখনও তাদের সাথে যোগাযোগ করি। প্রতি বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য জাপানে যাই এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই, মানুষের সাথে দেখা করি এবং যোগাযোগ করি। আমি বেশিরভাগ জাপানের শহরে গিয়েছি, এমনকি সুনামিতে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ দেখতেও গিয়েছি। তারা হল আমার দেখা সবচেয়ে নরম কথ্যার, অ দ্বন্দ্বমূলক, ভদ্র মানুষ। আমি কখনোই কোনো জাপানি রাষ্ট্রদূত বা কূটনৈতিক কর্মীকে বা কোন মানুষকে কোনো উন্মুক্ত ফোরামে বা প্রকাশ্যে সরকারের বা অন্য কাউকে সমালোচনা করতে দেখিনি বা তা আমার জানা নাই। যদি আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের আর অন্য কিছু সময়ের জাপানি নৃশংসতার বিষয়টি না উত্থাপন করি, তাহলে জাপানিরা সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত বিনয়ী এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিয়মের সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন কারণ তারা তাদের সংস্কৃতি এবং নিয়মকে সম্মান করে। তাই প্রশ্নের উত্তরে জাপানের রাষ্ট্রদূত সেদিন একটি উন্মুক্ত ফোরামে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যা বললেন তা পড়ে আমি খুব অবাক হয়েছি।রাজধানীতে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত মহামান্য মি: নাওকি ইতো নাওকি বলেন, ‘গত (জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে আমি শুনেছি। অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’ হ্যাঁ জাপান বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় দাতাদের মধ্যে একটি এবং মেগা প্রকল্পে বাংলাদেশকে আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং বস্তুগতভাবে সাহায্য করছে। ঋণের কারণে, যা বাংলাদেশকে সুদের সাথে ফেরত দিতে হবে, ব্যাংলাদেশকে সাহায্য করার একই সাথে ঋণের টাকার কারনে জাপান তার বড় শিল্পকে সাহায্য করছে যেমন মেট্রো রেল উৎপাদন ও বিক্রয় করছে এবং খুব অল্প হলেও সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, জাপানে তাদের অর্থনীতিকে বড় করছে। এটি একটি জয় জয়ের খেলা, একটি শূন্য যোগের খেলা নয়। তাই ঋণের টাকা জাপানকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নেতিবাচক কথা বলার স্বাধীনতা দেয় না। সবাইকে একটি পারস্পরিক কূটনৈতিক শালীনতা বজায় রাখত হবে। আমাদের সবার সমান সম্মান ও মর্যাদা থাকতে হবে। আমি কখনই ভাবিনি যে এটি হবে, জাপান থেকে নয়। এটি কি ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টির একটি সাজানো পরিকল্পিত খেলা? কি লজ্জা! আমি ভাবছি বাংলাদেশের মানুষের নাকি বাক-স্বাধীনতা বা তথ্য বা গণমাধ্যমের কোনো অধিকার নেই, তাহলে কিছু সাংবাদিক এমন প্রশ্ন করার সাহস পায় কেমন করে?

মার্কিন টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন রবার্ট বোল্টন কী বলেছিলেন তা কি এখনও মনে আছে? তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে কোন দেশের নেতা যদি তাদের পররাষ্ট্র নীতি বা চাহিদার বা দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় বা গ্রহণ না করে তবে সেই শাসন বা শাসক পরিবর্তনের তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি চাপ এবং জাতীয় অশান্তি তৈরির বিভিন্ন উপায় এবং কৌশল সম্পর্কে কথা বলছিলেন। যেমন কিছু প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, স্থানীয় সংবাদপত্র, টিভি বা রেডিও কেন্দ্র গুলোতে টাকা দিয়ে কিনে একটা অশান্ত বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করা, মিথ্যা ছড়ানো, বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা, শাসক বা ক্ষমতাসীন দলকে পৈশাচিক নিষ্ঠুর একনায়কে তৈরি করা। কূটনৈতিক চাপ, আর্থিক হুমকি বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। মিথ্যা প্রচনা, গুজব ছডিয়ে দিয়ে জনসংখ্যাকে আতঙ্কে ফেলে আন্দোলনকে সমর্থন করা। এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে শাসন/শাসক পরিবর্তনের ব্যাপক বিশৃঙ্খলা বা আন্দোলন শুরু হয়। তিনি অন্য আরো পদ্ধতি সম্পর্কে কথা বলতে চাননি। মনে আছে কি তারা একই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করে হয় শাসন পতন ঘটিয়েছে অথবা দেশ আক্রমণ করেছে যেমন তারা ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, বসনিয়া, পানামা বা ভিয়েতনামে করেছিল। তাই এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে কেন কিছু কূটনৈতিক মিশন এবং এর প্রধানরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সার্বভৌম বিষয় নিয়ে এত নির্দ্বিধায় কথা বলছেন!

আসুন তাদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বজায় রাখার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনে সচরাচর ঘোলা জলে মাছ ধরার উদ্দেশে বাংলাদেশে তাদের ব্যাপক মিথ্যা এবং জাল খবর, আতঙ্ক, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির করা সাম্প্রতিক সুপরিকল্পিত/পূর্বপরিকল্পিত সহ আরে কিছু ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। আলোচনা করি আর্থিক হুমকি এবং অভ্যুত্থানের মাঠ গরম করার কথা।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯৯৭ সালে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় (যা প্রসারিত হয় রাশিয়া এবং ব্রাজিলের মতো দূরবর্তী দেশগুলিতেও) থাই বাথ পতনের সাথে শুরু হওয়া আর্থিক মন্দার কথা। ঋণ খেলাপি হওয়া এড়াতে ওই দেশগুলোকে আইএমএফের দরজায় কড়া নাড়তে হয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অভাবে ইন্দোনেশিয়া আইএমএফের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। অনেক পশ্চিমা দেশ সুহার্তোর শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল তাই রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক সরকারী কর্মচারীদের ছাঁটাই, কর বৃদ্ধি, জ্বালানি ও খাদ্যের উপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করার মতো অনেক কঠোরতামূলক ব্যবস্থা আরোপ করেছিল। আইএমএফের সেই দাবিগুলি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে জেনে সুহার্তো প্রাথমিকভাবে আইএমএফের দাবির সাথে একমত হতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু চাপের কারণে তাকে আইএমএফের শর্তাবলীতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। ফলাফল সরুপ আর্থিক মন্দা, জীবনযাত্রার বর্ধিত মূল্যস্ফীতি বেশিরভাগ সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ জনগণের জীবন-জীবিকা বজায় রাখা কঠিন এবং অসম্ভব হয়ে ওঠে, রাস্তায় আন্দোলন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত সুহার্তো ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন। পশ্চিমা শক্তি তারা যা চেয়েছিল তাই হল। তারপর থেকে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলি আর্থিক সংকট এবং ঋণ পরিশোধের সংকট মোকাবেলা করতে এবং ভবিষ্যতে আইএমএফের উপর নির্ভরতা কমাতেএবং বহিরাগত শক্তির আরোপিত নীতি/নির্দেশ মানতে বাধ্য না হওয়ার জন্য নিজ নিজ দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো শুরু করে। তাই গত কয়েক দশক খুব আরামদায়ক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কারনে বাংলাদেশের কোনো আইএমএফ ঋণের প্রয়োজন ছিল না কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়া পরিস্থিতি বাংলাদেশকে বিদেশি হস্তক্ষেপের সম্মুখীন করছে। এই ভূ-রাজনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের কোনো দোষ বা নিজের সৃষ্টি নয় কিন্তু এখন দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক নেতাদের বা দলের এই অবস্থায় খুব কম বিকল্প আছে। আপনার কাছে সময় থাকলে অনুগ্রহ করে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ানের সাম্প্রতিক নিবন্ধটি পড়ুন "আইএমএফ কি উদ্দেশ্যের জন্য উপযুক্ত (Is the IMF fit for purpose?)"

চলুন আবার চলে আসি প্রথম আলোর আরেকটি নিবন্ধে “বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পরিবেশ তৈরির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের”। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক প্রশ্নের উত্তরে এই আহ্বান জানান। ব্রিফিংয়ে নেড প্রাইসের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হবে। যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানাবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে নেড প্রাইস বলেন, বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কসহ পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই তারা নিয়মিতভাবে বিষয়গুলো তাদের আলোচনায় তুলে থাকে”। প্রশ্ন হল নেড প্রাইস যা বলল তা নয়, প্রশ্ন হল কিন্তু কেন এবং কে এই প্রশ্নটি করেছিল? যুক্তরাষ্ট্র যখন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আর কাজ করছে, যেমন মূল্যস্ফীতি এবং নিজের দেশে গৃহস্থালির জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, ইউক্রেনের যুদ্ধ, চীনের সাথে সম্পর্ক, ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের নিষেধাজ্ঞাকে সম্মান না করা বা রাশিয়ার নিন্দা না করা তখন এই সমস্ত বিষয়গুলির মধ্যে তাদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ? বাংলাদেশ ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করার জন্যই কি সেই প্রশ্ন কোন ভাড়া করা লবিস্ট বা কিছু বাংলাদেশী বিরোধী লোক বা তথাকথিত সাংবাদিক করেছে? নাকি এর পিছনে লুকানো হাত আছে।

কেন হঠাৎ করে আমরা মিথ্যা শুনছি যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাঙ্কে নগদ অর্থ নেই। কেন কিছু স্বার্থান্বেষী পক্ষ মিথ্যাভাবে বলছে এবং বিদেশে কর্মরত বা বসবাসকারী ব্যক্তিদেরকে আইনি মাধ্যমে টাকা না পাঠাতে এবং তৃতীয় পক্ষের হুন্ডি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের অর্থ পাঠানোর জন্য উত্সাহিত ও পরামর্শ দিচ্ছে? কেন বাংলাদেশ ব্যাংককে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হল যে বাংলাদেশে নগদ টাকা প্রবাহের সংকট নেই। কেন বার বার মানুষকে আশ্বস্ত করতে হচ্ছে যে তারা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে সন্দেহ বা অসুবিধা ছাড়াই তাদের টাকা তাদের পরিবার সময়মত, ঠিক পরিমান পাবেন। কেউ কি মনে করেন, এই মিথ্যার প্রসার ইচ্ছাকৃত নয় এবং এর সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও দালালরা সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়?

আসুন আবারও প্রথম আলোর কল্লোল মোস্তফার নিবন্ধ “রাষ্ট্রায়ত্ত কল বন্ধ রেখে ডেকে আনা চিনি সংকট” নিয়ে কথা বলি। নিবন্ধের হেড লাইনের দিকে তাকান, যা অনেকেই পড়বেন, হয়ত পুরো নিবন্ধটি না পড়ে, সরকারের ব্যর্থতার কারণে কৃত্রিম চিনির সংকট হচ্ছে বলে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কল্লোল মোস্তফা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন সরকারকে কেন তার নিজস্ব কারখানায় চিনি উৎপাদন কমাতে বা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে তার কারণগুলি। যেমন তিনি লিখেছেন স্থানীয়ভাবে উত্পাদন করা চিনি বেশি ব্যয়বহুল যখন আমদানি করা চিনি অনেক সস্তা বা কৃষকরা বেশি দাম না পাওয়ায় আর বেশী আখের চাষ করছেন না, চিনি কারখানাগুলো পর্যাপ্ত আখ পাচ্ছে না তাই সরকারী কারখানাগুলো আর লাভ জনক না হয়ে অনেক ক্ষতির কারন হচ্ছে। যদি তার উদ্দেশ্য মিথ্যা আতঙ্ক সৃষ্টি করা না হয়, তাহলে দয়া করে কেউ কি আমাকে বলবেন কল্লোল মোস্তফা কেন তার নিবন্ধে ঐ শিরোনামটি ব্যবহার করেছেন?।

ইদানিং কালে জেলাগুলোতে বিএনপি জনসমাবেশে যোগদান দিতে শত শত মানুষ দুই তিন দিন আগে জেলাগুলিতে আসছেন, রাত কাটাচ্ছেন, টাকা খরচ করছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে বিএনপি এত বিপুল পরিমাণ টাকা কোথা থেকে পাচ্ছে, কে দিচ্ছে? আপনি যদি এই সমস্ত ধীরে ধীরে কিন্তু খুব পদ্ধতিগতভাবে সৃষ্ট ঘটনাগুলি এবং আরও অনেকগুলি ঘটনা বিশ্লেষণ করেন তা হলে বুঝতে কঠিন হবে না সরকারকে দুর্বল করার জন্য এবং বহিরাগত প্রভাব ও শাসন চাপিয়ে দেওয়ার জন্য গত কয়েক দশকের মানব উন্নয়নের বিশাল উন্নতিকে ম্লান করার একটি চলমান ষড়যন্ত্র চলছে। অনুগ্রহ করে আমাকে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক ভেবে ভুল বুঝবেন না, ভাববেন না আমি সবকিছুতেই সবসময় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাই। সাম্প্রতিক ঘটমান ঘটনা আমাদের অন্যথায়/ অন্যভাবে না চিন্তা করতে বাধ্য করছে। আমরা কি মনে করি এই সমস্ত ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই ঘটছে কোন ইচ্ছাকৃত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্ররোচনা ছাড়াই?

আমি একমত যে সরকারকে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে, সমস্ত দুর্নীতিবাজ নেতা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী বা ব্যবসায়ীদের বন্ধ করে শাস্তি দিতে হবে। আকাশ ছোঁয়া দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, ঋণ খেলাপি কমাতে হবে, কঠোর ব্যাবস্থা নিতে হবে, কষ্টার্জিত অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব কমাতে হবে। তবে এগুলি আমাদের কোন বহিরাগত, অন্যান্য দেশের সমর্থন ছাড়া অবশ্যই আমাদের নিজেদের করতে হবে। এটি ঠিক করার জন্য আমাদের অন্য দেশ বা দূতাবাসের কাছে ভিক্ষা করার দরকার নেই। কোন অযথা হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য এটি আমাদের সমস্যা। আমাদের মর্যাদা, সম্মান এবং গর্ব নিয়ে বাঁচতে হবে।

আমি মনে করি সরকারকে আরো সজাগ হতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে তাদের কাজের সমন্বয় করতে হবে এবং আলোচনা করতে হবে কিভাবে আমরা এই অসুবিধাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারি এবং নিশ্চিত করতে পারি যে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমলাদের তাদের নিজ স্বার্থের উপরে উঠে, দেশের আর জনগনের কথা ভাবতে হবে, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যদিকে, প্রতিটি নাগরিক, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, প্রতিষ্ঠান যারা আমাদের মুক্তির জন্য লড়াই করেছে, যারা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে এবং বাংলাদেশে বিশ্বাস করে, যারা আমাদের শক্তিতে বিশ্বাস করে, যাদের আত্মসম্মান আছে, তাদের সবাইকে অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে, একে অপরকে সমর্থন করতে হবে। এটা সহযোগিতা ও সহযোগিতার সময় এবং একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় নয়। সাহসী হোন এবং বিশ্বাস রাখুন। নিজস্ব ক্ষমতা এবং শক্তির উপর বিশ্বাস রেখে আমরা সবাই মিলে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিকে যা আমাদের সৃষ্টি নয় কাটিয়ে উঠতে পারি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন। তার ক্ষমতা, তার দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তিনি অতীতে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নিরাপদে জাতিকে নেভিগেট করেছেন, অনেক হত্যার শিকার হয়েও নিজের উপর বিশ্বাস হারান নি , থেমে যাননি। তিনি আবারও আগামী দিনে আমাদের পথ দেখাবেন এবং নেতৃত্ব দেবেন এবং বাংলাদেশকে একটি সম্মানিত গর্বিত উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন।

Prof Dr Quazi Monirul Islam, MBBS, MPH, FRCOG
Epidemiology Department, Prince of Songkla University, Hat Yai, Thailand
Senior Specialist, International Centre for Migration, Health and Development 
Former Senior Specialist (Maternal and Newborn), Liverpool School of Tropical Medicine, UK
Former WHO Director and Country Representative to Thailand and Namibia



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭