ইনসাইড থট

ভাষার মাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 07/02/2018


Thumbnail

ফেব্রুয়ারি মাস এলে ভাষা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা বিকশিত হয়। মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা ও সাধারণভাবে ভাষা নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়, মিডিয়াতে ঢেউ ওঠে, কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষ হলে এই মনোযোগও ফুরিয়ে যায়। আমার এই লেখটিও ফেব্রুয়ারির ভাবনা থেকে তৈরি, কিন্তু আমি চেষ্টা করি ভাষা নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা সারা বছর সক্রিয় রাখতে। আমার সুবিধা এই যে, একজন শিক্ষক হিসেবে সারা বছর আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটাই- শ্রেণীকক্ষে, শ্রেণীকক্ষের বাইরে ভাষা নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, ভাষার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অথবা এর অভাব সম্পর্কে জানতে পারি। এবং মাঝে মধ্যেই এসব বিষয় নিয়ে লিখতে পারি। তবে আমিও মনে করি ফেব্রুয়ারি এক বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে। ভাষা নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। ফলে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা বিষয়ে কিছু না কিছু লিখতে উৎসাহ জাগে।

আজ আমার লেখার বিষয় তরুণদের ভাষা। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, একজন ভাষা ব্যবহারকারী তার ভাষা শেখে পরিবারে, সমাজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। মা এবং বাবা,ভাইবোন ও অন্যান্যরা যেভাবে তাকে ভাষা শেখায়, সেভাবেই শেখে। সেই ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয় যখন সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়, সমাজের সদস্য হয়।

পরিবারে ভাষার যে চর্চা হয়, সেই ভাষাই তার অধিকারের বিষয় হয়। আমি দেখেছি, আমেরিকা বা কানাডাতে অনেক বাঙ্গালি পরিবারের সন্তানেরা বাংলায় কথা বলতে পারে না, লিখতে বা পড়তে পারা তো দূরের কথা। এইসব পরিবারের বাবা মা রা তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন, যেহেতু সন্তানদের ওই ভাষাতেই কাজ কর্ম করতে হবে। অথচ কোরিয়া থেকে যাওয়া অভিবাসীরা তাদের সন্তানদের তাদের ভাষায় দক্ষ করে তোলে। বাঙ্গালি সন্তানদের ক্ষেত্রে বাংলা না শেখার দায়টা তাই সন্তানদের নয়, দায় বাবা মার।তারা যদি বাংলার প্রতি দায়বদ্ধ না হন, বাংলার প্রতি তাদের ভালবাসা না থাকে, তাহলে কি আর করার থাকে।

আজকের তরুণরা যে বাংলাভাষা ব্যবহার করে তা কতটা বাংলা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমি নিজেও কষ্ট পাই, যখন তাদের বাংলা চৌরাস্তা থেকে উঠে আসে। খিস্তি-খেউড়ের শব্দপদ অকাতরে তাদের ভাষায় চলে আসে। তাদের বাংলায় ইংরেজি নানা শব্দ থাকে অনেক অংশ জুড়ে, এবং বাংলা বিশেষণ ও ক্রিয়াপদও চলে যায় ইংরেজির দখলে।কিন্তু এ নিয়ে তরুণদের ওপর দোষারোপের কোন কারণ নেই, কারণ তারা যে ভাষা-বাস্তবতায় বড় হচ্ছে, তার চরিত্র জুড়ে আছে এইসব সমস্যা। এই সমস্যা, এইখানে বলে নেওয়া ভাল, বাংলা ভাষায় (এবং হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায়) যতটা, ততটা কোন পশ্চিমা ভাষায় মোটেও দেখা যায় না। ডাচ, ফরাসি, ইংরেজি বা জার্মান ভাষা একে অপরের থেকে এবং অন্যান্য ভাষা থেকে অনেক শব্দ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেগুলি আত্মীকরণ করে নিয়েছে। ঘা ওঠা আঙুলের মতো সেগুলো ভাষায় শরীরে জেগে থাকেনা।একজন ওলন্দাজ বা ফরাসী তরুণ তাদের ভাষাটাকে জগাখিচুড়ি ভাষায় পরিণত করেনি বরং খুবই সুললিত ভাবে ‍সুন্দর ভাবে, আস্থার সঙ্গে ব্যবহার করে। আমাদের তরুণদের ভাষা খুবই জগাখিচুড়ি। খুবই ‘ফিউশন এবং কনফিউশনের’ ভাষা।

প্রত্যেক ভাষারই অনেকগুলো রূপ থাকে, যেমন, আঞ্চলিক ও কথ্য ভাষা, ইয়ার দোস্তির ও খিস্তিখেউড়ের ভাষা, চৌরাস্তার ও মাস্তানির ভাষা। একই সঙ্গে সেই ভাষার ব্যবহারকারীরা একটি মানভাষা ব্যবহার করে যে ভাষাটি সাহিত্যের মূলভাষা, বিজ্ঞান, দর্শন চিন্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার ভাষা। এই প্রতিটি রূপই গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটি না থাকলে ভাষার বৈচিত্র্য কমে যায়। ওলন্দাজ বা ফরাসী ভাষাভাষী তরুণরা বিষয়টি জানে। শ্রেণীকক্ষে তারা সবচেয়ে সুন্দর বা মানভাষাটির চর্চা করে;বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় তাদের ভাষাটির একটু বদলে যায়। কিন্তু সবগুলি মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি তারা তৈরি করে না। এসব ভাষা গৃহীত নানা শব্দপদকে নিজের মতো করে নিয়েছে। সেগুলো আর কানে লাগে না। তারা কখনো ‘সেন্ড করো’ বা ’লাইক করো’ বলবে না। এ দায় শুধু আমাদের তরুণদের।

আমাদের তরুণদের সমস্যাটা তৈরি হয় পরিবার থেকে। এখন বেশিরভাগ পরিবারে পড়ার সংস্কৃতি অনুপস্থিত। আছে দেখার সংস্কৃতি। পড়ার সংস্কৃতি ভাষার শ্রেষ্ঠ রূপগুলির সঙ্গে একজন পড়ুয়াকে পরিচিত করায়। বই না পড়লে ভাষার নানান প্রকাশ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহল জাগেনা। আর দেখার সংস্কৃতি নির্ভর করে দৃশ্যের ওপর। দৃশ্য হচ্ছে সিনেমা, টেলিভিশন বা কম্পিউটার পর্দায় দেখা ছবি। ছবি বা দৃশ্যের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ নয়, এর গভীরতাও ( যদি না দক্ষ নির্মাতার হাতে সেগুলি তৈরি না হয়) থাকে না।সেজন্য দৃশ্য চোখকে তৃপ্তি দেয়। কিন্তু কমক্ষেত্রেই গভীর চিন্তা জাগায় না, বা একটি বইয়ের পাতা যে রকম যোগাযোগ ঘটায়, তা ঘটায় না। এজন্য ভাষা ব্যবহারে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দেয়।

শ্রেণীকক্ষে একজন শিক্ষার্থী তাঁর শিক্ষকের ভাষায় প্রভাবিত হয়, ভাষা ব্যবহারে তাঁকে অনুসরণ করে। যদি শিক্ষক জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলেন, তাহলে শিক্ষার্থীও তাই করবে। আমি দেখেছি, এখন একজন শিক্ষার্থীকে এত পরীক্ষা দিতে হয়, এত মুখস্ত করতে হয়, এত কোচিং এ যেতে হয় যে, ভাষা নিয়ে চিন্তা করার তাঁর সময়ই থাকে না।

তরুণরা দেখে শেখে। তাছাড়া, তারা সহজে প্রভাবিতও হয়। তরুণরা অনুকরণীয় ব্যক্তিদের, রোল মডেলদের অনুসরণ করে। যদি তারা দেখে অনুসরণীয় ব্যক্তিরাও জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলছেন, তখন তারাও বলে। টেলিভিশন এক সময় অনেক তারকা তৈরি করত, এখন ইউটিউব করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক তারকা তৈরি হচ্ছেন, যাদের কথা শোনা যায়। তাদেরও তরুণরা নকল করে। এখন দেখা যায় অনেকেই ভাষা নিয়ে ভাবেন না, যেনতেন ভাবে বলে যান, উচ্চারণে শুদ্ধতার প্রয়োজন বোধ করেন না। অনেকে ইংরেজি শব্দের বহুল মিশ্রণে বাংলাকে ‘বাংলিশ’ করে তোলেন। তরুণরা এদের অনুসরণ করে। আবার কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা মনে করেন এসব কোনো ব্যাপার না। তরুণরা যা বলে তাই সই। তাই ‘অস্যাম’।

অবশ্যই নয়। যার ভাষা পরিষ্কার নয়, তাঁর চিন্তাও পরিষ্কার নয়। গ্রামের একজন কৃষক তাঁর ভাষায় (আঞ্চলিক) কথা বলেন, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না, কিন্তু তিনি তো সুন্দর ভাবে তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন।

আমাদের তরুণদের মাতৃভাষা নিয়ে অহংকার করতে হবে, তাদের আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে, তাদেরকে ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশের উদাহরণ দিতে হবে।

তবে যে বিষয়টি প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে, তা হচ্ছে এই যে প্রত্যেক ভাষার সবগুলি রূপই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলারও। আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষার চর্চা করব, যেখানে প্রয়োজন কথ্যভাষা ব্যবহার করব, আবার শিক্ষার জন্য আমাদের সৃজনশীল ও মননশীল চিন্তা প্রকাশের জন্য একটি মানভাষাও ব্যবহার করব। তরুণরা যদি এ বিষয়টি বুঝতে পারে তাহলে বাংলা ভাষার আরো সমৃদ্ধি ঘটবে।


বাংলা ইনসাইডার/ডিজি/ডিকে



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭