ইনসাইড পলিটিক্স

হাওয়া ভবনের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক ডাকাতরা এখন তারেকের অর্থদাতা?


প্রকাশ: 13/12/2022


Thumbnail

বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে। তারেক জিয়ার বন্ধু গিয়াস উদ্দীন আল মামুনকে অবৈধ ভাবে টাকা দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। সেই সময় ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিক হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ব্যাংক ডাকাত’ গোষ্ঠী অবিশ্বাস্য ভাবে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এখন তারা আবার গোপনে বিএনপি এবং তারেককে অর্ধ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি সহ কোন মহল ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি নিয়ে নানা কথা বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংক লোপাটে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল তাদের আমলেই।

২০০৪ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক (সাবেক আল-বারাকা ও বর্তমান আইসিবি ব্যাংক) এর সাবেক  ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশের বিরুদ্ধে ৫৯৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে অভিযোগ প্রমাণের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেয়া হয় তাদের।

অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্তদের তালিকায় ছিলেন ব্যাংক মালিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। জাল দলিল, ভুয়া একাউন্ট, ভাউচার এর মাধ্যমে ব্যাংকের কারওয়ান বাজার, নবাবপুর, মতিঝিল ও অন্যান্য দুটি শাখা থেকে এই অর্থ কেলেঙ্কারি সংগঠিত হয়। যা কিনা দেশের ইতিহাসে প্রথম বড় অর্থ কেলেঙ্কারি। 

২০০৬ সালের ১৯ জুন ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আসলে তদন্তের সময় কেলেঙ্কারির বিষয়টি উন্মোচিত হয়। এরপর ২০০৭ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় অর্থ আত্মসাতের মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে আন্তঃশাখা লেনদেনের ভুয়া ভাউচার, ভুয়া একাউন্ট, কৃত্রিম উৎস এবং আমানত দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে। 

এরপর ঐ বছর ২৭ আগস্ট ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রদান করে দুদক। ব্যাংকের মালিক সহ অভিযুক্তরা বাকিরা হলেন, ব্যাংকের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট শাহ মহাম্মদ হারুণ ও একেএম মাহমুদ উল্লাহ, সাবেক দুই সহকারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও এ কে এম নেয়ামতুল্লাহ এবং এক্সিকিউটিভ রাকিবুল ইসলাম।  

২০০৭ সালের ২৭ আগস্ট মামলার চার্জশীটে একটি ভুয়া একাউন্টে ৬ কোটি ৭০ লক্ষ্য টাকা জমা দেয়ার অভিযোগ দেখানো হয়। এরপর ঐ বছর অক্টোবর ৩১ তারিখে বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালতে চার্জশীট জমা দেয় দুদক। দুদকের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে, বিশেষ আদালতের রায়ে ব্যাংকের মালিককে কারাদন্ড ও ৬কোটি ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে বাকি অভিযুক্তদের প্রত্যেককে ৫ বছর কারাদন্ড ও ৫০,০০০ হাজার টাকা জরিমানা করে।  

ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের তৎকালীন প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেংথেনিং প্রজেক্টের সাবেক মহাব্যবস্থাপক রফিউল আলম। রফিউল আলম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সাবেক নায়েবে আমির মাওলানা একেএম ইউসুফের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তার পরিচালক থাকা অবস্থায় এই আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আরো জানা যায়, তিনি পরিচালকের  দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে পরিচালনা পর্ষদের মোট ২২টি সভা অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে ব্যাংকের বিশাল আত্মসাতের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি কখনোই। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, যেই জাল কাগজগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো সে নথিগুলো নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান ব্যাংকটির কারওয়ান বাজার শাখার ব্যবস্থাপক আশরাফ আলী। কিন্তু ওই নথিগুলর ফটোকপি বাংলাদেশ ব্যাংকের দখলে থাকায় শেষমেশ জালিয়াতি ধরা পড়ে।

আত্মসাৎকৃত অর্থের সিংহভাগই বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াস উদ্দিন আল-মামুনের মালিকানাধীন ওয়ান ডেনিম মিলস অ্যান্ড ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের নামে নগদ করা হয়েছিলো। বেশীরভাগ সময়ে অই জাল নথিগুলোতে স্বাক্ষর করেছেন ব্যাংকের মালিক প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক শাখার দুই কর্মকর্তা নাজিয়া আক্তার ও সিদ্দিকা। তাদের স্বাক্ষরে অনেক পে-অর্ডার এবং নগদ টাকাও জমা ছিল।

ওয়ান ডেনিম মিলস, ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট এবং এগ্রোবার্ডস-এর নামে জমা করা পে-অর্ডারগুলো ওরিয়ন গ্রুপ পেতো। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকানা যায় হওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। এরপর এই কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে।

ওরিয়ন গ্রুপের অধীনে আসার আগে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটু এই ব্যাংকের মালিক ছিলেন। লিটুর মালিকানাধীন সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ পরিমাণ ছিলো ১৪৩ কোটি টাকা। 

১৯৮৭ সালে আল-বারাকা ব্যাংক হিসাবে যাত্রা শুরু করে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক ।  কিন্তু ১৯৯৪ সালে 'ত্রুটিপূর্ণ ব্যাংক' হিসাবে চিহ্নিত করা হলে পরে তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং এর সহযোগী সংস্থাগুলি ব্যাংকের ৮৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এরপর ২০০৪ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে এটি তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসাবে কাজ শুরু করে।  ২০০৭ এ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে অর্থ কেলেঙ্কারি ধরা পরলে ব্যাংকের অন্তর্বর্তী প্রশাসক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক  মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের হস্তক্ষেপে তখন ব্যাংকটি বন্ধ করা হয়নি। পরবর্তীতে ব্যাংকটির শেয়ার মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিলে ২০০৯ সালে আইসিবি নামে আত্মপ্রকাশ করে আবার।

মূলত বিএনপির আমলেই ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকানা গ্রহণ করা এই শিল্প গ্রুপের প্রসার ঘটে এবং ওই সময়ই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই ব্যবসায়ী। ওই সময় নিয়মিত হাওয়া ভবনে যাতায়াত করতেন এবং তারেক জিয়ারও বেশ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বিএনপির আরেক নেতা হারিস চৌধুরীর সঙ্গেও ওই সময় তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে তিনি রাজধানীর একটি উড়াল সেতুর কাজসহ বেশ বড় ধরনের টেন্ডার ওই সময় বাগিয়ে নেন। আর এভাবেই তিনি তার ব্যবসার প্রসার ঘটান। সরকার পরিবর্তনের পর তিনি ভোল পাল্টে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম চালিয়ে যান। বিভিন্ন সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির আন্দোলনে অর্থের যোগানদাতা হিসেবে দেশের বেশকিছু ব্যবসায়ীর হাত রয়েছে। এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা গোপনে বিএনপিকে অর্থায়ন করছেন এবং দেশ থেকে টাকা লন্ডনে পাচার করছেন। এরকম বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা লন্ডনে তারেককে বিভিন্নভাবে নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। এ ব্যাপারে একাধিক সংস্থা কাজ করছে বলে জানা গেছে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭