ইনসাইড থট

পিটার হাসের ঘটনায় সুসম্পর্ক বিনষ্ট হবে না


প্রকাশ: 17/12/2022


Thumbnail

১৪ ডিসেম্বর(২০২২) শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব উভয়ে। কারণ মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন রাজধানীর শাহিনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় যান, তখন বাইরে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ‘মায়ের কান্না’নামের আরেকটি সংগঠনের কিছু ব্যক্তি। ‘মায়ের কান্না’১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি, কারাদণ্ডের শিকার ও চাকরিচ্যুত সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেন। আসলে সেদিনকার ঘটনার আকস্মিকতার কারণে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তরফ থেকে প্রতিক্রিয়াটা হয়েছে।একইদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিস্থিতি ‘ক্লারিফাই’করেছেন।

২. সেদিন শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণে অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বললেন যে তিনি এক বাসায় গিয়েছিলেন, আর সেখানে যখন গিয়েছেন, কিন্তু বাইরে বহু লোক ছিল। তারা উনাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। উনার সিকিউরিটির লোকেরা উনাকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তারা বলেন যে ‘‘ওরা আপনার গাড়ি ব্লক করে দেবে’’। সেই নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা থেকে তিনি তখন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেছেন। এবং এতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’ তিনি জানান, ‘আমি উনাকে (রাষ্ট্রদূত) বললাম যে আপনার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমাদের। আপনার ওপর বা আপনার লোকের ওপর কেউ আক্রমণ করেছে? উনি বললেন যে, ‘‘না’’। তবে উনি বললেন যে, উনার গাড়িতে হয়ত দাগ লেগেছে। তবে এটা শিওর না। আমি বললাম, আপনার লোকদের নিরাপত্তা আমি দেব। আপনি যদি অধিকতর নিরাপত্তা চান আমরা দেব।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন বলে জানান আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘আপনি ওখানে গেছেন এই খবরটা কীভাবে কে প্রকাশ করল, আমরা তো জানি না। আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু জানি না। আমাদের তো জানাননি। এ তথ্য লিক করল কে? ওইটার উনি উত্তর দিতে পারেননি। তো আমরা এটাই বলেছি, আপনি বরং বের করেন, আপনি ওখানে যাচ্ছেন, এটা কেমন করে প্রচার হলো, আপনার লোকই তো করতে পারে।’ মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব মহোদয়ের মতে, ওই তুচ্ছ ঘটনার কারণে দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না।কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক অনেক দিনের পুরনো।এজন্য একটি ঘটনা বা আচরণ সেই সম্পর্ক রিমুভ করে ফেলবে, সেই সম্ভাবনা নেই।এটাকে সিকিউরিটি থ্রেট হিসেবে দেখারও সুযোগ নেই।তাছাড়া ঢাকার মধ্যে কূটনীতিকদের চলাফেরায় অনুমতি লাগে না। তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন।

ঘটনা পরিষ্কার যে সেদিন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকে সরকার সমর্থকরা বাধা ও বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করেননি।যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি)’র উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে এদেশের কিছু মানুষের অপপ্রচার যা সরকারকেও বিব্রত করার জন্য যথেষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্র যেমন চায় নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার পরিবেশ বাংলাদেশে তৈরি হোক তেমনি শেখ হাসিনা সরকারও চায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরির সকল প্রচেষ্টা ব্যাহত করতে।ঢাকা-ওয়াশিংটন (দ্বিপক্ষীয়) সম্পর্কের মূল উপাদান হিসেবে স্বাধীন গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সামনে এসেছে। বাইডেন প্রশাসনের যে কর্মকর্তা গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, সেই ব্যক্তি সম্ভবত অবগত নন যে এদেশের নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে করার পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমও কাজ করে যাচ্ছে। মার্কিন দূতের গাড়িবহরের গতিরোধের ঘটনা আসলে আদৌ ঘটেনি।

বাসা থেকে বেরিয়ে যখন পিটার হাস গাড়িতে উঠছিলেন, তখন ‘‘মায়ের কান্না’’ সংগঠনের লোকজন স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশি তৎপরতার জন্য একপর্যায়ে তারা নিরাশ হন।পরে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা থানা-পুলিশের সদস্যদের সহায়তায় তিনি গাড়িতে উঠে চলে যান। এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেছেন, ‘মায়ের কান্না নামে একটি সংগঠনের লোকজন এসেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে স্মারকলিপি দিতে। তিনি ওই বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠেন, কোনো দিকে কর্ণপাত না করে চলে যান। কোনো হট্টগোল হয়নি।’

প্রকৃতপক্ষে ১০ ডিসেম্বর(২০২২) বিএনপি’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে ব্যাপক সরকার বিরোধী অপতৎপরতা ও অপপ্রচার দেশ-বিদেশে চলেছে তারই প্রতিক্রিয়া হলো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওই ঘটনা।এজন্য ৯ ডিসেম্বর ও ১৪ ডিসেম্বর (২০২২)আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে লক্ষ্য করে বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ও আদালতপাড়া নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করবেন না।আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে চায় বাংলাদেশ।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিমাসে কতজন গুম হয় সেই চিত্রটা কিন্তু সিএনএনে আমরা দেখেছি। কতজন ধর্ষণের শিকার হয় সেটাও আমরা দেখেছি। কতজন খুন হয় সেই চিত্রও আমরা দেখেছি।’ তিনি জানান,  বিএনপির এ রকম অসংখ্য কর্মী আছে। মামলা থেকে রক্ষা পেতে নিখোঁজ।আর একারণেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ওয়াশিংটন মিশন সফল হয়নি।যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ২০ দেশের ৭০ জনের বিরুদ্ধে। সেখানে বাংলাদেশ নেই। তবুও টোবি ক্যাডম্যানকে লবিস্ট নিয়োগ করেন খসরু।ওই লবিস্ট সাক্ষাৎকারে আল জাজিরাকে বলেছিল, ‘আমি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য, পুলিশ এবং র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যকে অনুরোধ করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র কথা রেখেছে, যুক্তরাজ্য আমার অনুরোধ রাখেনি।’

এর আগে পিটার হাস রাজধানী ঢাকায় ভয়ভীতি প্রর্দশন ও রাজনৈতিক সহিংসতার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানান দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে। অথচ তার আগের মাসে (৩ নভেম্বর, ২০২২) সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন মার্কিন এই রাষ্ট্রদূত।সেদিন তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর আগে ১০ আগস্ট(২০২২) তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ কোনো দলকে সমর্থন করে না।সেখানে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।

৩. তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের চরম অবনতির কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং তাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিসর অনেক বিস্তৃত।দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চার মাস পর ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে তৎকালীন মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও মার্কিন জনগণ, কংগ্রেস ও সিনেট স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কূটনৈতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য মার্কিন সাহায্য পেতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয় যার অধীনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য বিভিন্ন পর্যায়ে পেতে শুরু করে।এক বৎসরের মধ্যে মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৪৩ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের এক তৃতীয়াংশ ছিল। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিশেষ দূত হিসেবে জন কনেলি বাংলাদেশে আসেন মার্কিন সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিতে। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ৪৫ মিনিটের এক মুখোমুখি আলাপ-আলোচনা হয় যা সরকারি পর্যায়ে প্রথম শীর্ষ বৈঠক হিসেবে মার্কিন-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে আবির্ভূত হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবার পর পুনরায় আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন দিগন্তে উপনীত হতে শুরু করে। তাঁর আমলে ২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল ঐতিহাসিক, যা প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সময় বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১০ মিলিয়ন ডলার। মহাজোট সরকারের আমলে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে মার্কিন সাহায্য আরও ব্যাপকতা লাভ করে। আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ, সমুদ্র বন্দরে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে মার্কিন সাহায্যের হাত প্রসারিত হয়েছে আরো। ২০০৯ সালের মার্কিন বাজেটে বাংলাদেশে সাহায্য কর্মসূচি বরাদ্দকরণে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে (ইউ এস এইড জাস্টিফিকেশন)। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কে অর্থনৈতিক সাহায্যের পাশাপাশি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রায়ণের বিষয়টি বেশ জোরালভাবে প্রাধান্য পায়। 

দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার অন্যতম প্রধান মিত্র এখন বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ বিরোধী ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে এ দুই রাষ্ট্র বেশকিছু সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাইডেন ও ট্রাম্পের আগে ওবামা প্রশাসনের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নমূলক বেশকিছু কাজে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিল। ২০১২ সালে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি হয়। এ সম্পর্ক এখন ‘স্পন্দনশীল, বহুমুখী এবং অপরিহার্য।’

২০১৬ সাল ওয়াশিংটনের অনুরোধে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে ‘কসভো’কে স্বীকৃতি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে তাদের নীতি মাঝে মাঝে পরিবর্তন হলেও দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে মার্কিন অবস্থান পাল্টায় নি। তবে মুসলমানবিরোধী নীতি নেই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২১ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়। তখন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সচল রাখার জন্য নতুন করে ৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। জঙ্গিবাদ দমনে অ্যান্টি-টেরোরিজম অ্যাসিসট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশকে ৩০ লাখ ডলার বরাদ্দ দিয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

৪. যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ও আমেরিকান জনগণের এবং বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী জনগণের কল্যাণ বয়ে এনেছে এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রসার ঘটিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক গতিশীল, বহুমুখী এবং অপরিহার্য। বাংলাদেশ দৃঢ় গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান সব মানুষের সমঅধিকার সংরক্ষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছে। তাদের মধ্যে অনেকে লেখাপড়া করছে। কেউ ব্যবসা করছে। কেউ চাকরি করছে। বাংলাদেশেও অনেক আমেরিকান বসবাস করছে। তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দু’দেশের জনগণ কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি হল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উদারচেতা হিসেবেই তারা দেখে থাকে। 

২০১৮ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ায় রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তবে তারা মনে করেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার জন্য গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য।যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন হলেও সম্পর্কের পরিবর্তন হয় না।অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বিরাজমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাস্তবিক আমেরিকার বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি বরং বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো বেশি পোক্ত হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সব দলের অংশ গ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচন দেখতে চেয়েছিল- তা সম্পন্ন হয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। বাংলাদেশের স্বার্থেই এমন নির্বাচন হয়েছে। অবশ্য ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে ধেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে আছে আমেরিকা।  এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর ওয়াশিংটনের কঠিন চাপ রয়েছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতা পাচ্ছি আমরা। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ ও ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ, সন্ত্রাসবাদ এবং সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতা বিষয়ে আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সাইবার অপরাধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলা, গণতন্ত্র এবং টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ-আমেরিকা একসাথে কাজ করছে। এ চারটি বিষয়েই আমরা ঘনিষ্ঠ মিত্র। অবশ্য আমেরিকা ও বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। বলা চলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চমৎকার। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে ফিড দ্য ফিউচারের আওতায় বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রদূতরা এদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গিবাদ সম্পর্কে জিরো টলারেন্স নীতির প্রশংসা করে গেছেন। কারণ তাঁদের মতে, শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই এখন আইএস’র বা অন্যসব জঙ্গিবাদের হুমকির মুখে রয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আমেরিকা বলেছিল ‘আমরা সব ধরনের অপরাধের বিচারের পক্ষে।’

৫. বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) রয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হল যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কৌশলগত সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম অবদানকারী রাষ্ট্র। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণের অন্যতম সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক অংশীদারি নির্ভর। এ সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। স্থিতিশীল পরিবেশে উন্নত ভবিষ্যৎ এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশটির প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।২০১৯ সালে নতুন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার এসে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, আর এই বিশ্বাস থেকেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চান। তিনি জানতেন এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধানে সক্ষম। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, একটি মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ, যে দেশ হবে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ।’ আমরা তাঁর সেই প্রত্যাশাকেই আলোকিত করে তুলেছি। এজন্য পিটার হাসের ঘটনায় বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্ক সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে স্থিত।অন্যদিকে দু’দেশের মধ্যে  গত ১৩ বছর ধরে সকল সহযোগিতামূলক কার্যক্রমই পরিচালিত হচ্ছে।কারণ এদেশে গণতন্ত্র আছে, আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এদেশের অবস্থান বিশ্বব্যাপী অভিনন্দিত। বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর সবচেয়ে বেশি মার্কিন সহায়তা লাভ করে চলেছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি (২০২১) মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।সেই আশাবাদে এগিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের এখন সুসম্পর্ক বিরাজ করছে। এজন্য ঠুনকো কোনো ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিনষ্ট হবে না বলে আমরা মনে করি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭