ইনসাইড গ্রাউন্ড

মেসিতেই ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান


প্রকাশ: 18/12/2022


Thumbnail

পেনাল্টি শুট আউট থেকে যখন গঞ্জালো মন্ট্রিয়েল বল জালে জড়ায় তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় ম্যাচের ভাগ্য। তাতে শুধু দোহার লুসাইল নয়, আরব সাগরের সেই ডেউ আছড়ে পড়ে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের বুয়েন্স এইরেসে। আর সেই ঢেউতে ভেসে যায় আর্জেন্টিনাসহ বিশ্বের শত কোটি সমর্থকরা। এই জয় শুধু বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের নয়, এই জয় ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান। এই জয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের একমাত্র অপূর্ণতা ঘোচানোর জয়। এই জয়ে নিজেদের ইতিহাসে তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুললো আলবিসিলেস্তেরা। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনা যে স্বাদ দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইনদের, সেটাই আবার ফিরিয়ে আনলেন লিওনেল মেসি। সকল হিসেব নিকেশ উল্টে ফ্রান্সকে টাইব্রকোরে হারিয়ে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি উঁচিয়ে ধরলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি।

কি ছিলো না লিওনেল মেসির বর্ণিল ক্যারিয়ারে। এক বাক্যে সে উত্তর দিয়ে দেয়া যায়, বিশ্বকাপ শিরোপা। তবে নিজের শেষ বিশ্বকাপে সে শিরোপার আক্ষেপ ঘুচিয়ে তার হাতে শোভা পেয়েছে বিশ্বকাপ শিরোপা। এতে একদিকে যেমন মেসির ক্যারিয়ার পূর্ণ হলো, তেমনি বিশ্বকাপও যেন পেলো পূর্ণতা। মেসির হাতে এই শিরোপা না উঠলে যে বিশ্বকাপের গায়েও থেকে যেত এক চিলতে কলঙ্ক। 

বিশ্বকাপের ফাইনাল। শুরু থেকেই ম্যাচে ছিলো সে আবহ। আক্রমণাত্নক ফুটবল খেলার চেষ্টা দুই দলের। তবে ম্যাচের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনার দাপুটে ফুটবলের কাছে পাত্তা পায়নি বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। ম্যাচের ৩ মিনিটেই মেসির বাড়ানো বল থেকে আক্রমণের চেষ্টা করেছিলো আর্জেন্টিনা। আলভারেজ গোলমুখে শট নেয়ার চেষ্টা করলেও অফসাইডের কারণে বাঁশি বাজান রেফারি। পরের মিনিটেই মেসিকে ফাউল করেন উপামেকানো। ৫ মিনিটেই ম্যাক অ্যালিস্টারের নেয়া দূরপাল্লার সরাসরি চলে যায় হুগো লরিসের হাতে।

৮ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে গোলমুখে শট নিয়েছিলেন দি পল। তবে ভারানের গায়ে লেগে বল চলে যায় বাইরে। ম্যাচের প্রথম কর্নার পায় আর্জেন্টিনা। তবে সেখান থেকে গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি আলবিসিলেস্তেরা।

১৪ মিনিটে প্রথমবার আর্জেন্টিনার রক্ষণে ঢোকার চেষ্টা করে ফ্রান্স। তবে কোন সুযোগ দেননি এমি মার্তিনেজ। সেখান থেকে কাউন্টার অ্যাটাকে ভাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো আর্জেন্টিনার। তিন মিনিট পর আবারো ফরাসিদের চেপে ধরে আকাশি নীলরা। তবে বক্সের ভেতর থেকে দি মারিয়ার শট বারের উপর দিয়ে চলে যায়। ২০ মিনিটে আর্জেন্টিনার বক্সের বাম প্রান্তে ফ্রি-কিক পায় ফ্রান্স। সেখান থেকে নেয়া গ্রিজম্যানের শটে জিরুর হোড বারের উপর দিয়ে যায়।

২২ মিনিটে ডি-বক্সের মধ্যে দি মারিয়াকে ফাউল করেন উসমান দেম্বেলে। সেখান থেকে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। স্পট কিক থেকেন গোল করে আর্জেন্টিনাকে প্রথম সাফল্য এনে দেন লিওনেল মেসি। এই গোলে বিশ্বকাপে পেলের  সমান ১২ গোলের মালিক হলেন লিও মেসি। এটি বিশ্বকাপে মেসির ৬ষ্ঠ গোল। ফাইনালে প্রথম।

দি মারিয়ার গোলে ব্যবধান বাড়ালো আর্জেন্টিনা

৩২ মিনিটে ম্যাক অ্যালিস্টারের প্রচেষ্টা  ব্যর্থ হয়। তবে ৩৫ মিনিটে নিজেদের অর্ধ থেকে দারুণ এক আক্রমণ চালায় আর্জেন্টিনা। ওয়ান টাচে মেসির কাছ থেকে বল পান ম্যাক অ্যালিস্টার। তারে বাড়ানো বল থেকে লরিসকে পরাস্ত করে দ্বিতীয়বার বল জালে জড়ান দি মারিয়া। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে না পারলেও ৮ বছর পর ফাইনালে মাঠে নেমেই গোলের দেখা পান মারিয়া।

দুই গোলে পিছিয়ে পড়ে ম্যাচের ৪১ মিনিটেই একাদশে জোড়া পরিবর্তন আনে ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম। উসমান দেম্বেলে-অলিভিয়ের জিরুকে উঠিয়ে র্যান্ডাল কোলো মুয়ানি এবং মার্কাস থুরাম মাঠে নামে। ম্যাচের নির্ধারিত সময়ে আর কোন গোল হয়নি। প্রথমার্ধে ৭ মিনিট অতিরিক্ত সময় যোগ করা হয়। প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচের প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন এনজো ফার্নান্দেজ।

মেসি-দি মারিয়ার গোলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।

বিরতির দুই মিনিট পর আবারো আক্রমণে যায় আর্ঝেন্টিনা। যদিও সেখান থেকে গোল আদায় করতে পারেন নি রদ্রিগো দি পল। ৫২ মিনিটে কর্নার পায় ফ্রান্স। তবে সেখান থেকেও ব্যবধান বাড়াতে পারেনি আলবিসিলেস্তেরা। পরের মিনিটে কর্নার কাজে লাগাতে পারেনি আর্জেন্টিনাও। ৫৫ মিনিটে দি পলকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন রাবিয়োত। ৫৯ মিনিটে জুলিয়ান আলভারেজের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। পরের মিনিটে মেসি আক্রমণে উঠলেও তা নস্যাৎ করে দেন রাবিয়োত।

৬৪ মিনিটে দি মারিয়ার বদলি হিসেবে মাঠে আসেন মার্কাস আকুনা। চার মিনিট পর মুয়ানির চেষ্টা প্রতিহত হয়। ৭১ মিনিটে ম্যাচে প্রথমবারের মতো ডি-বক্সে দেখা যায় এমবাপ্পেকে। তবে তার নেয়া শট চলে যায় গ্যালারীতে। সে সময় গ্রিজম্যান-থিও হার্নান্দেজকে উঠিয়ে নেন দেশম। মাঠে নামেন কামাভিঙ্গা-কিংসলে কোম্যান। পরের মিনিটে এনজো ফার্নান্দেজের শট ক্লিয়ার করে দেন।

৮০ মিনিটে মুয়ানিকে ফাইলের কারণে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। সেখান থেকে গোল করে ব্যবধান কমায় কিলিয়ান এমবাপ্পে। সেই গোলের রেশ না কাটতেই পরের মিনিটে আবারো বল জালে জড়ান এমবাপ্পে। ৭ গোল করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এই ফরাসি স্ট্রাইকার। মার্কাস থুরামের কাছ থেকে বল পেয়ে দারুণ এক শটে বল জালে জড়ান এমবাপ্পে।

৮৭ মিনিটে পেনাল্টি আদায়ের চেষ্টা করায় হলুদ কার্ড দেখেন থুরাম। ম্যাচের নির্ধারিত সময়ে আর কোন গোল হয়নি। অতিরিক্ত সময়ে তিন মিনিটের এমবাপ্পের প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যায়। পরের মিনিটে মার্টিনেজ আবার বাঁচিয়ে দেন আর্জেন্টিনাকে। ৯৫ মিনিটে বেঞ্চে থাকা জিরুকে হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। ম্যাচের একদম অন্তিম মুহুর্তে মেসির শট কর্নারের বিনিময়ে বাইরে পাঠিয়ে দেন হুগো লরিস। নির্ধারিত সময়ে আর কোন দলই গোল করতে না পারলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

পেনাল্টি শ্যুট আউটে প্রথম গোল থেকে বল জালে জড়ান এমবাপ্পে। আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম শট থেকে বল জালে জড়ান লিওনেল মেসি। তবে কিংসলে কোম্যানের নেয়া দ্বিতীয় শট আটকে দেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। পরের শটে লক্ষ্যভেদ করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন পাওলো দিবালা। তৃতীয় শট থেকেও গোল করতে ব্যর্থ হয় ফ্রান্স। চুয়ামেনির নেয়া শট পোস্টের বাইরে দিয়ে যায়। আকাশি-নীলদের হয়ে ভুল করেন নি লিয়ান্দ্র পারেদেসেও। মুয়ানির নেয়া চতুর্থ শট জাল খুঁজে পায়। তবে পরের শটে মন্ট্রিয়েল বল জালে জড়ালে আনন্দে আত্নহারা হয়ে উঠে আলবিসিলেস্তেরা। ৩৬ বছর নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা।

আলবিসিলেস্তেদের সাথে অপেক্ষার অবসান হয় দলটির কোটি কোটি সমর্থকদের। এ জয় অনেক প্রতীক্ষার, এই জয় দীর্ঘ সময়ের প্রত্যাশার। এই জয় অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত একটি দেশের দুঃসময়ের স্বস্তির বাতাস এনে দেয়ার। এই জয় লিওনেল আন্দ্রেস কুচিত্তিনি মেসির ক্যরািয়ারের একমাত্র প্রশ্নবোধক চিহৃ সরিয়ে দেয়ার। এই জয় ইতিহাসের। যে ইতিহাস রচিত হয়েছে দুই লিওনেলের মাহকাব্যিক পথচলার। জয়তু মেসি, জয়তু আর্জেন্টিনা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭