প্রকাশ: 19/12/2022
লিওনেল আন্দ্রেস
মেসি। রোজারিওর ছোট শহর সান্তা ফে'র বিস্ময় বালক। হোর্হে হোরাসিও মেসি এবং সেলিয়া মারিয়া
কুচিত্তিনির তৃতীয় সন্তান। চরম টানাপোড়নের মাঝেও ছেলের ফুটবলের প্রতি আগ্রহ চোখ এড়ায়নি
তাদের। মাত্র ৬ বছর বয়সে লিওনেল আন্দ্রেস মেসি যোগ দেন নিওয়েলস ওল্ড বয়েস ক্লাবে।
বয়স যখন ১০,
তখন হরমোন সংক্রান্ত জটিলতায় পড়েন মেসি। ব্যয়বহুল সে চিকিৎসার সামর্থ্য ছিলো না পরিবারের।
সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রাখতে পারেনি তার শৈশবের ক্লাব। রিভার প্লেট তার প্রতিভার
দাম দিলেও, চিকিৎসার খরচ বহনে অস্বীকৃতি জানায়। তবে তার কদর বুঝতে ভুল করেনি স্প্যানিশ
ক্লাব বার্সেলোনা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ২০০১ সালে মেসির সাথে চুক্তি করে কাতালানরা।
মাত্র কয়েক
মিনিট মেসির কারিকুরি দেখে বিমোহিত হয়ে পড়েন বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লেস
রেক্সাস। ক্লাবের আপত্তি উপেক্ষা করে ন্যাপকিনেই মেসির জীবনের প্রথম চুক্তিপত্রটা সই
করিয়ে ফেলেন। সাথে নেন চিকিৎসার ভারও। 'লা মাসিয়া'য় গড়ে ওঠা মেসি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
পা দিয়েই প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন। কালক্রমে হয়ে ওঠেন সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার।
মেসির সামনে
সুযোগ ছিলো- আর্জেন্টিনা ও স্পেন দুই দেশের হয়েই খেলার। তবে স্পেনের প্রস্তাব প্রত্যাখান
করে নিজ দেশ আর্জেন্টিনাকে বেছে নেন তিনি। ১৭তম জন্মদিনের পাঁচদিন পর অনুর্ধ্ব-২০ দলের
হয়ে আর্জেন্টিনা দলে অভিষেক। ২০০৫ সালে হোসে পেকারম্যানের অধীনে জাতীয় দলে অভিষেক হয়
তার। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ৬৩ মিনিটে বদলি হিসেবে মাঠে নামার দুই মিনিট পর ফুলব্যাক ভিমোস
ভ্যানচাককে ফাউল করে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। যা এখন পর্যন্ত সেটিই মেসির
ক্যারিয়ারের একমাত্র লাল কার্ড হয়ে আছে।
ক্লাব ও জাতীয়
দলে সৌরভ ছড়িয়ে হয়ে ওঠেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা। বর্ণিল ফুটবল ক্যারিয়ারে ছুঁয়েছেন সাফল্যের
সর্বোচ্চ শিখর। তবে ক্লাবের হয়ে যতটা ভাল, জাতীয় দলে ঠিক ততটা নন- এমন আলোচনা শুরু
হয় তাকে নিয়ে। ক্লাবের হয়ে যেখানে তার অর্জন আকাশচুম্বী, জাতীয় দলের হয়ে বারবার ফিরতে
হয়েছে শূন্য হাতে। রেকর্ড ৭বার ব্যালন ডি অর', চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগসহ তার ট্রফি
কেসে রয়েছে ফুটবলের প্রায় সকল সম্মাননাই। তবে জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জিততে না পারাটা
হয়ে ওঠে গলার কাটা।
২০০৬ সালে বিশ্বকাপে
অভিষেক। সেবার খুব একটা সুযোগ পাননি তিনি। পরের আসরে আর্জেন্টিনার দ্বায়িত্বে ছিলেন
তাদেরই কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা। ততদিনে ম্যারাডোনা সাথে তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছিলো
মেসির। দুই জনের কাঁধে ভর করে আরো একটি শিরোপা স্বপ্ন দেখছিলেন আলবিসিলেস্তেরা। তবে
সে আশায় গুড়েবালি। কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে যায় ম্যারাদোনা-মেসির পথচলা।
২০১৪ বিশ্বকাপ।
ফর্মের তুঙ্গে থাকা মেসি একাই বিশ্বকাপে টেনে নিতে থাকেন দলকে। একে একে সব বাঁধা পেরিয়ে
১৯৯০ সালের পর বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলেন আর্জেন্টিনাকে। মেসির হাত ধরে আরো একবার শিরোপা
স্বপ্ন আঁকে দক্ষিণের দলটি। তবে জার্মানির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় দলটির। বিশ্বকাপ
ট্রফির হাতছোয়া দুরত্ব দিয়ে অবনত মস্তকে হেঁটে যাওয়া লিওনেল মেসির চাহনি বলে দিচ্ছিলো-
"কত কাছে, তবুও যেন কত দূরে"। পরের বিশ্বকাপে দলের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে
থাকার ভার বইতে পারেন নি সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে আর্জেন্টিনা।
তবে ২০২২ বিশ্বকাপের
আগে চিত্রটা ছিলো পুরোপুরি ভিন্ন। এর আগে কোপা আমেরিকায় টানা দুটি ফাইনাল হারের পর
অভিমান ও ক্ষোভে জাতীয় দলকে বিদায় জানান মেসি। তবে কোচ লিওনেল স্কালোনি হাল ছাড়েন নি।
আবার তাকে ফিরিয়ে আনেন আকাশি-নীল জার্সিতে। ২৫০ দিনের অবসর ভেঙে যখন মেসি ফিরলেন, তার
সাথে যেন দল হয়ে ফিরলো আর্জেন্টিনা। ২৮ বছরের আক্ষেপ কাটিয়ে ২০২১ সালে ব্রাজিলকে হারিয়ে
জেতে কোপা আমেরিকার শিরোপা। উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে টানা ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরতে থাকা আলবিসিলেস্তেরা।
মাঝে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জেতে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে।
ক্যারিয়ারের
পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে কাতার আসেন মেসিরা। আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন এটিই তার শেষ বিশ্বকাপ।
পুরো ক্যারিয়ারে তার একমাত্র অপূর্ণতা যে বিশ্বকাপ, সেই শিরোপা উঁচিয়ে ধরার শেষ সুযোগে
পরিণত হয় বিশ্বকাপের ২২তম আসর। এবারো ব্যক্তি নৈপূর্ন্যে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন। তবে
দলটি এবার আর মেসি নির্ভর নয়। মেসিকে বিশ্বকাপ উপহার দিতে ঐক্যবদ্ধ পুরো দল। ফলে স্বাধীনভাবে
খেলার সুযোগ পেয়ে দলকে নিয়ে আসেন ফাইনালে। যা সবশেষ তিন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয়
ফাইনাল। দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ দুরন্ত ফ্রান্স।
ম্যাচের আগে প্রশ্ন ছিলো লুসাইল কি ফিরিয়ে আনবে মারাকানার স্মৃতি, নাকি লিখবে নতুন
ইতিহাস?
এবার আর ভুল
করেন নি লিওনেল মেসি। ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয় শিরোপা জেতার পাশাপাশি নিজের নামের পাশে
থাকা সকল প্রশ্নবোধক চিহৃকে সরিয়ে রেখে হাতে নেন বহু আকাঙ্খার সেই সোনালী ট্রফি। তর্কাতীতভাবে
পরিণত হন কিংবদন্তিতে। ট্রফি কেসের একমাত্র শূন্য স্থানটি পূরণ করেন সামনে থেকে নেতৃত্ব
দিয়ে। বিশ্বকাপের পুরো আসর জুড়ে রেকর্ড বইয়ের পাতায় ওলট-পালট ঘটিয়ে।
আর্জেন্টিনার তো বটেই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলার লিওনেল মেসি। জাতীয় দলের জার্সিতে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৩ গোল তার। তবে অন্য একটি রেকর্ডে অনন্য হয়ে গেছেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। বিশ্বকাপের প্রায় শতবর্ষের ইতিহাসে গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল- প্রতিটি ম্যাচেই গোল করা একমাত্র ফুটবলার যে তিনিই।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭