ইনসাইড গ্রাউন্ড

বিশ্বকাপময় একটা বছর: ফিরে দেখা ২০২২


প্রকাশ: 24/12/2022


Thumbnail

ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সাথে সাথে পেরোতে থাকে সময়। সেকেন্ড-মিনিট-ঘন্টার হিসাব রূপান্তরিত হয় দিন-মাস-বছরে। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সাথে পাল্লা দিয়ে শেষের পথে আরো একটি বছর। অপেক্ষা ২০২২ পেরিয়ে ২০২৩ সালের। ক্রীড়া জগতে ২০২২ সাল যেন বসিয়েছিল নানা রং এর পসরা। বছরব্যাপী নানা টুর্নামেন্ট নিয়ে ব্যস্ত সময় কেঁটেছে ক্রীড়াবিদদের। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, অ্যাথলেটিকস- ভিন্ন ভিন্ন প্রতিযোগিতার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিলো বিশ্ব। একেকটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা মিলন ঘটায় নানা বর্ণ ও  সংস্কৃতির। ২০২২ সালে ক্রীড়াজগত এবং ক্রীড়াবিদদের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদন।


জানুয়ারি

এশিয়ায় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। তবে পৃথিবীব্যাপী ফুটবলের যে জনপ্রিয়তা সে তুলনায় এশিয়ার এই ক্রিকেট উন্মাদনাকে দুধভাত বলাই যায়। তবে বছরের শুরুটা অবশ্য হয়েছে ক্রিকেটের রোমাঞ্চেই। ক্রিকেট ভক্তদের কাছে "অ্যাশেজ" একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা। প্রতিবছর বড়দিনের পর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাঝে অনুষ্ঠিত এই পাঁচ ম্যাচের এই টেস্ট সিরিজ। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির ডামাডোলে টেস্ট ক্রিকেট রং হারালেও, অ্যাশেজ সেখানে ব্যতিক্রম। ক্রিকেটার থেকে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষ নজর থাকে এই সিরিজে। এ বছর নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে অ্যাশেজ নিজেদের করে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

বছরের শুরুটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও ছিলো দুর্দান্ত্। ব্যর্থতার বৃত্তে আষ্টেপৃষ্টে থাকা বাংলাদেশের জন্য ছিলো নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের মতই। পহেলা জানুয়ারিতে মাউন্ট মঙ্গানুইতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলতে মাঠে নামে সাকিব-লিটনরা। সে টেস্টে কিউইদের ৮ উইকেটে হারিয়ে বছর শুরু করে বাংলাদেশ। যা নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়। যদিও সে জয়ের সাফল্য বছরের বাকি সময়ে ম্লান হয়ে যায় একের পর এক ব্যর্থতায়। 

ক্রিকেটের মতো নতুন বছরের শুরুতে ফুটবলও ছড়িয়েছে রোমাঞ্চ। ক্যামেরুনে বসে আফ্রিকান নেশন্স কাপের ৩৩তম আসর। এটি আফ্রিকা মহাদেশের দলগুলোর সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা প্রতি দুই বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর ২৪ দলের লড়াই শেষে প্রথমবারের মতো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা যায় সাদিও মানের সেনেগালের কাছে।

এ মাসেই মাঠে গড়ায় টেনিসের অন্যতম প্রধান টুর্নামেন্ট অস্ট্রেলিয়া ওপেন। ১৭-৩০ জানুয়ারি মেলবোর্ন পার্কে পুরুষ ও নারী- উভয় বিভাগেই চলে এই প্রতিযোগিতা। সেখানে পুরুষ এককে জয়ী হন স্পেনের রাফায়েল নাদাল। আর নারী এককের শিরোপা জেতেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশলেহ বার্টি।


ফেব্রুয়ারি

পরের মাসে চীনে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ক্রীড়ার আরেক মহাযজ্ঞ- উইন্টার অলিম্পিকস। সেখানে অংশ নেয় ৯১টি দেশের ২ হাজার ৮৭১ জন অ্যাথলেট। প্রতিযোগিতা হয় ভিন্ন ভিন্ন ১৫টি ডিসিপ্লিনে। সর্বোচ্চ ১৬টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৩৭টি পদক নিয়ে সবার উপরে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করে নরওয়ে। ১২টি স্বর্ণসহ ২৭টি পদক নিয়ে দ্বিতীয় হয় জার্মানি। শীর্ষ পাঁচে থাকা বাকি দলগুলো হলো স্বাগতিক চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইডেন।  


মার্চ-এপ্রিল

৪ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাসমান সাগর পারের দেশ নিউ জিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় নারীদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ৮ দলের অংশগ্রহণে টুর্নামেন্টটিতে অনুষ্ঠিত হয় ৩১টি ম্যাচ। খেলা চলে ৩টি ভেন্যুতে। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে নিজেদের সপ্তম শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া।


মে

বছরজুড়েই ক্লাব ফুটবলের ব্যস্ত সূচী থাকে এখন। তবে বছরের মাঝামাঝি আসতেই ফুটবলের উত্তেজনা পায় ভিন্ন মাত্রা। ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ প্রতিযোগিতাগুলোর শিরোপা নির্ধারনী লড়াইয়ে নামে ক্লাবগুলো। স্তাদ দে ফ্রান্স স্টেডিয়ামে লিভারপুলকে হারিয়ে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সবেচেয় বড় সম্মাননা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। এর আগে অবশ্য চেলসিকে টাইব্রেকারে ৬-৫ গোলে হারিয়ে ইংলিশ ফুটবলের অন্যতম প্রতিযোগিতা এফএ কাপের শিরোপা জিতেছিলো লিভারপুল। আর রেঞ্জার্সকে হারিয়ে ইউরোপা লিগের মুকুট যায় জার্মান ক্লাব আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুটের ঘরে।

এ মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয় টেনিসের শীর্ষ চার প্রতিযোগিতার দ্বিতীয়টি। রোঁলা গারোয় ২২ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ফ্রেঞ্চ ওপেন। পুরুষ এককে বছরে নিজের দ্বিতীয় শিরোপা পকেটে পোড়েন লাল কোর্টের রাজা রাফায়েল নাদাল। আর নারী এককে চ্যাম্পিয়ন হন পোল্যান্ডের ইগা সিয়াতেক।


জুন

বছরের তৃতীয় মেজর টেনিস টুর্নামেন্ট উইম্বলডন অনুষ্ঠিত হয় এ মাসে। ২৭ জুন থেকে ১০ জুলাই গ্রান্ড স্লামের লড়াইয়ে নামেন টেনিস তারকারা। পুরুষ এককে সেরার মুকুট পড়েন সার্বিয়ান তারকা নোভাক জকোভিচ। আর নারী এককের শিরোপা জেতেন কাজাখাস্তানের এলেনা রিবাকিনা।


জুলাই

বছরের প্রথমভাগ পার হতেই মাঠে গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট। সাইক্লিং এর সবচেয়ে মর্যাদাজনক প্রতিযোগিতা ট্যুর দি ফ্রান্সের আসর বসে জুলাইতে। এছাড়া ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় আরো দুটি শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিযোগিতা নারীদের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ এবং কমনওয়েলথ গেমস। জার্মানদের হারিয়ে নারীদের ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয় ইংলিশরা। আর কমনওয়েলথভুক্ত ৭২ দেশের ৫ হাজার ৫৪ জন অ্যাথলেটরা অংশ নেন কমনওয়েলথ গেমসে। যেখানে ৮০টি স্বর্ণপদক সহ ১৯৮টি পদক জেতার কৃতিত্ব দেখায় অস্ট্রেলিয়া।


আগস্ট-সেপ্টেম্বর

এ মাসের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট। এশিয়ার ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই- এশিয়া কাপের ১৫তম আসর বসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে হারের পর চমক দেখিয়ে নিজেদের ৬ষ্ঠ এশিয়া কাপ শিরোপা ঘরে তোলে শ্রীলঙ্কা।

একই সময়ে মাঠে গড়ায় ইউএস ওপেনের খেলা। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছরের জন্য পর্দা নামে টেনিসের শীর্ষ চার টুর্নামেন্টের। নরওয়ের ক্যাসপার রুডকে হারিয়ে শিরোপা জেতেন স্পেনের কার্লোস আলকারাজ। নারী এককে গ্রান্ড স্লাম জয়ের কৃতিত্ব দেখান ইগা সিয়াতেক।

তবে এ মাসে বিয়োগাত্নক ঘটনার সাক্ষী হতে হয় ক্রীড়া জগতকে। চোখের জলে এ মাসেই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান টেনিস কিংবদন্তি রজার ফেদেরার। প্রায় দুই যুগের ক্যারিয়ারে অসংখ্য সুন্দর মুহুর্তের উপহার দেয়া তারকার বিদায়ের দিনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন কোর্টে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদাল-নোভাক জকোভিচরাও। চোখের জলে তারা বিদায় জানান টেনিসের এই মহা তারাকে। সমাপ্তি হয় এক নিখাদ সুইস ভদ্রলোকের বৈচিত্রময় টেনিস ক্যারিয়ারের। বিদায় বেলায় তাই বলাই যায়, ধন্যবাদ রজার, সব সুন্দর মুহুর্তের জন্য, আপনার লড়াকু মানসিকতার জন্য- যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দূরের ধ্রুবতারার মতো টেনিসের আকাশে উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াবেন তিনি, যে আলোয় উদ্ভাসিত হবেন তার অনুজেরা।


অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর

চলতি বছর ক্রীড়াজগতে সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চ ও উত্তেজনা বিরাজ করেছে শেষ তিন মাসে। এ সময়ের মধ্য অনুষ্ঠিত হয়েছে দুটি বিশ্বকাপ আসর। একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, অপরটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ ফুটবল বিশ্বকাপ- দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ।

১৬ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অষ্টম আসর। টুর্নামেন্টের আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়া। ১৬ দলের অংশগ্রহণে ৭টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয় ৪৫টি ম্যাচ। ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে নিজেদের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় জশ বাটলারের ইংল্যান্ড। টুর্নামেন্ট সেরা হন ইংলিশ অলরাউন্ডার স্যাম কারেন।

তবে ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে আকাঙ্খিত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা অপেক্ষার অবসান হয় ২০ নভেম্বর। দীর্ঘ ৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেদিন পর্দা উঠেছিল ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসরের। কাতারে বিশ্বকাপের শিরোপা লড়াইয়ে মাঠে নামে ৩২ দল। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা হয় সারা পৃথিবীতে। নানা বর্ন-সংস্কৃতির মেলবন্ধনে ভিন্ন মাত্রা পায় পৃথিবী। অস্থির সময়ে খানিকটা স্বস্তির বাতাস এনে দেয় এই মহাযজ্ঞ। পছন্দের দলের হয়ে গলা ফাঁটান সমর্থকরা। আর প্রতিটি ফুটবলার তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার চেষ্টায় মাঠে নিজেদের উজার করে দেন।

ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ হিসেবে অ্যাখা দেয়া হয়েছে কাতার বিশ্বকাপকে। একের পর এক চমক দেখা গেছে মাঠের খেলায়। ইউরোপ-লাতিনের বড় দলগুলোর সাথে সমানতালে লড়েছেন আফ্রিকা-এশিয়ার দলগুলোও। এমনকি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোলের দেখা পাওয়া গেছে এই আসরে। ম্যাচ শেষে কোন দলের বুক ফেঁটেছে আবার কোন দল মেতেছে বুনো উল্লাসে। মরুর বুকে ফুল ফুঁটিয়ে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমিফাইনালে খেলার কীর্তি গড়ে মরক্কো।

যার সমাপ্তি হয় এক কিংবদন্তির বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার মধ্য দিয়ে। ১৮ ডিসেম্বর দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। একদিকে ৩৬ বছরের শিরোপা আক্ষেপের অবসানের মঞ্চ, লিওনেল মেসি নামক জাদুকরের বর্ণিল ক্যারিয়ারের একমাত্র প্রশ্নবোধক চিহৃ উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ ছিলো আলবিসিলেস্তেদের। অন্যদিকে টানা দুটি বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস গড়ার হাতছানি ছিলো ফ্রান্সের সামনে।

বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ল্যাসিক ফাইনালের সাক্ষী হয় সেদিন লুসাইলের গ্যালারীতে থাকা প্রায় ৯০ হাজার দর্শক। জমজমাট লড়াইও উত্তেজনার পর টাইব্রেকার ফ্রান্সকে হারিয়ে ১৯৮৬ সালের পর তৃতীয় বিশ্বকাপ ঘরে তোলে লাতিন আমেরিকার দলটি। কাঙ্খিত ও আরাধ্য বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন লিওনেল মেসি। পূর্ণতা পায় তার ক্যারিয়ার, সেই সাথে পূর্ণতা পায় বিশ্বকাপও। কারণ মেসির হাতে ট্রফিটি না উঠলে একটু হলেও অপূর্ণতা থেকে ১৮ ক্যারেট সোনার বিশ্বকাপটির।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭