আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো। গতকাল অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ পুরনো কমিটির ওপরই আস্থা রেখেছে। খুব বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। কয়েকজনকে শুধুমাত্র রদবদল করা হয়েছে, দু-একজন বাদ পড়েছেন। এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগের কমিটির ওপরই আস্থা রেখেছেন এবং আগের কমিটি আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই মনোভাব তিনি পোষণ করেছেন কমিটিতে বড় পরিবর্তনে না গিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে কি আওয়ামী লীগকে অতি আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে? আওয়ামী লীগ কি বিরোধীদলের আন্দোলন কিংবা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, এ বিষয়গুলোকে তেমন আমলে নিচ্ছে না? আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের পর এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা মনে করছেন যে, আওয়ামী লীগের সামনে যে কঠিন সময় রয়েছে সেই কঠিন সময়ে নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিলো, একটি নতুন বার্তা দেয়া প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি সেই সেই পথে না গিয়ে পুরনোদের ওপর আস্থা রেখেছেন। তিনি হয়তো অনেকগুলো বিষয় এখানে বিবেচনায় এনেছেন। তার মধ্যে রয়েছে-
প্রথমত, দলের নেতৃত্ব পরিবর্তন করে পুনর্গঠন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন না করার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিলো যে, সামনে নির্বাচনের জন্য স্বল্পতম সময়ে রয়েছে। এই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব এসে দল গোছাতে সময় নিতে পারে, নাও পারতে পারে। এজন্য পুরো নেতৃত্বকেই রাখা হয়েছে যেন আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই নেতৃত্ব দায়িত্ব পালন করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগসহ হয়তো চিন্তা করেছেন যে যেভাবে তিনি একাই দল পরিচালনা করছেন সেই প্রক্রিয়াতে তিনি দল পরিচালনা করবেন। এখানে নতুন কাউকে নিয়ে এসে কোনো ধরনের নিরীক্ষা তিনি করতে চাননি।
তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে বিভাজন এবং তৃণমূলের যে বিভক্তিটা আছে সেটা আরও বেড়ে যেতে পারে। এই বিবেচনা থেকেই হয়তো তিনি আওয়ামী লীগের কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের পথে যাননি। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ নানামুখী চাপে রয়েছে। দলের ভেতরে-বাইরে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই চাপগুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন ছিলো বলেও কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। তারা যেমন মনে করেন যে, বিরোধী দলের আন্দোলনকে মোকাবেলা করার জন্য কিছু মাঠের কর্মীকে সামনে আনা প্রয়োজন, যারা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অভিজ্ঞ এবং দুর্দিনে কঠিনভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেরকম ব্যক্তিদেরকে সামনে আনা হয়নি। যার ফলে সামনে যদি বিরোধী দলের আন্দোলন হয় সেই আন্দোলন আওয়ামী লীগ কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটি হলো একটি বড় প্রশ্ন।
চতুর্থত, আওয়ামী লীগের ভিতর গত কিছুদিন ধরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র আকার ধারণ করেছিলো। বিশেষ করে তৃণমূলের কোন্দল একটি বড় ধরণের সমস্যা হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে এসেছে। আওয়ামী লীগ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে একক প্রার্থী দিতে পারেনি, বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি হয়েছিলো। যদিও দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো যে, বিদ্রোহী প্রার্থীদেরকে আজীবনের জন্য দল থেকে নিষিদ্ধ করা হবে কিন্তু সেই অবস্থানেও আওয়ামী লীগ থাকতে পারেনি। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাউন্সিলের আগেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এসবের পরও আওয়ামী লীগের ভেতরে যে কোন্দল, সেই কোন্দল থামেনি। যার ফলে আওয়ামী লীগের পুরনো নেতৃত্ব এই কোন্দলকে কতটুকু সমাধান করতে পারবে, সেটা দেখার বিষয়।
পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক চাপ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ একটি ভালো রকম চাপ অনুভব করছে। এই চাপ মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কমিটিতে কিছু পরিবর্তন অনেকে প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু এবার কাউন্সিলে সেই পরিবর্তনের পথে হাঁটেনি আওয়ামী লীগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই কমিটি কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবে?
এই নানা প্রশ্ন গুলো সামনে এসেছে এবং সেখান থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একটি কথা মনে করছে যে, আওয়ামী লীগ কি অতি আত্মবিশ্বাসী? টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দলটি কি প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবছে? সেজন্যই পুরনো কমিটিতে আস্থা রাখলো? এই প্রশ্নটি এবার নতুন কমিটির পর সবচেয়ে বেশি করে সামনে চলে এসেছে।