ইনসাইড ইকোনমি

অর্থনীতিতে সাফল্য ও শঙ্কা জাগিয়ে বিদায় নিলো ২০২২


প্রকাশ: 27/12/2022


Thumbnail

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো আরও একটি বছর। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর পর ২০২২ সালই সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল একটি বছর বলা যেতে পারে। এই ঘটনাবহুল বছরের সবচেয়ে বেশি প্রভাব সরাসরি এসে পড়েছে অর্থনীতিতে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যার থেকে রেহাই পায়নি ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোও। দেউলিয়া হয়েছে ছোট অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সংকট, রিজার্ভ সংকট, ডলারের মুল্য বৃদ্ধি সবমিলিয়ে অনেকটা টানাপোড়নের মধ্যেই ছিল ২০২২ সালে দেশের অর্থনীতি। চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আলোচিত ঘটনাগুলো।


জ্বালানি সংকট: 

মূলত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই বিশ্বজুড়ে জ্বালানিসংকট শুরু হয়। রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ ডিসটিলেট রপ্তানিকারক। কিন্তু ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও বয়কটে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে দেশটির রপ্তানি। এর ফলে ডিজেলের প্রাপ্যতা কমেছে। এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত ডিজেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ১৭০ ডলার পর্যন্ত। কিন্তু বিশ্ব বাজারে যখন দাম নিম্নমুখী তখনই দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় প্রায় ৫১.৬৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। 

মূল্যবৃদ্ধির হার যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অনেকটা অসহনীয় পর্যারে বেড়ে যায় এবং এর প্রভাব সরাসরি এসে পরে দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের জনগণের উপর। ভর্তুকি কমাতে এবং পেট্রোবাংলার লোকসান কমাতে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে বলে জানানো হয়। 


লোডশেডিং: 

১৯ জুলাই থেকে দেশে শুরু হয় পরিকল্পিত লোডশেডিং। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের আমদানি মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হয় যার কারণে সারাদেশে শুরু হয় লোডশেডিং। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে। অক্টোবর মাসে তা বেড়ে হয় আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। লোডশেডিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব পরে গার্মেন্টস এবং কলকারখানাগুলোতে। যার ফলে ব্যাহত হয় উৎপাদন। 


স্বপের পদ্মা সেতু:

গত ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এরই মধ্যে এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। নতুন নতুন কারখানা, মুনাফা বৃদ্ধি আর পর্যটকের সংখ্যা বাড়ায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। ইতোমধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে পদ্মা সেতুর সুবাদে, কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে মোংলা বন্দরেও। 


মূল্যস্ফীতি:

বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বড় খলনায়ক হয়ে অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে মূল্যস্ফীতি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই দেশে মূল্যস্ফীতির অঙ্ক ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মে, জুন, জুলাই মাসে তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে আগস্ট মাসে গিয়ে পৌঁছায় ৯.৫২ শতাংশে, যা ছিল গত ১১ বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এই মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও তা এখনো ৮.৫ শতাংশের ওপরে। কয়েক মাস ধরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।


মাথাপিছু আয়:

দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। যা গত বছরের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ২৩৩ ডলার বেশি। মাথাপিছু আয়ে আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও অনেক এগিয়ে।


রেমিট্যান্সের উত্থান-পতন:

রেমিট্যান্স প্রবাহ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার। এরপর রেমিট্যান্স প্রবাহ ওঠানামা করলেও গত অক্টোবরে রেমিট্যান্স আগের ৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম এসেছিল। গত অক্টোবরে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। তবে চলতি নভেম্বর শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২১ সালের নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।

অবশেষে নিম্নমুখী ধারা থেকে বের হতে পেরেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের চেয়ে সদ্য সমাপ্ত নভেম্বর মাসে কিছুটা বেড়েছে। নভেম্বর মাসে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ  মার্কিন ডলার, আগস্টে এসেছে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার এবং নভেম্বর এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার।


ডলার সংকট এবং মূল্য বৃদ্ধি:

আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় এ বছর ডলার সংকট তীব্র আকার ধারন করে। কয়েক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ টাকা থেকে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৫.৮২ টাকা।


রিজার্ভে চাপ:

ডলার-সংকট সামাল দিতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি ও খাদ্যপণ্যের আমদানি দায় মেটাতেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। এর ফলে কমে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত বছরের অগাস্ট নাগাদ বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছালেও এখন সেটি ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মোট রিজার্ভের পরমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা এবং ঋণ হিসেবে দেয়া আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার।


সোনার দামে রেকর্ড:

চলতি বছর ৪ ডিসেম্বর সব থেকে ভালোমানের ২২ ক্যারেটের সোনার দাম ভরিতে ৩ হাজার ৩৩ টাকা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৪৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৪ হাজার ৫৬৪ টাকায়।


আইএমএফ ঋণ:

আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাবার জন্য চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সংস্থাটির সাথে বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা হয়েছে। পরবর্তি তিন মাসের মধ্যেই এই ঋণের সব আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করবে বলে জানায় সংস্থাটি। মোট সাত কিস্তিতে তারা বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। এ ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদ হার নির্ধারিত হবে বাজারদর অনুযায়ী, যা গড়ে দুই দশমিক দুই শতাংশ হবে।


রপ্তানি আয়ে রেকর্ড:

এবছর রপ্তানি আয়ে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। নভেম্বরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা স্বাধীনতার পর এই প্রথম। এর আগের দুই মাস অক্টোবর ও সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছিলো যথাক্রমে ৪.৩৬ বিলিয়ন ডলার এবং ৩.৯১ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে গত কয়েক মাস রপ্তানির গতিতে কিছুটা ভাটা থাকলেও অক্টোবরের পর নভেম্বরেও পজিটিভ গ্রোথ হওয়ায় সার্বিকভাবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ।

 

বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি:

আমদানি ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমলেও দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে চলেছে। আমদানিতে যে পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে  তারচেয়ে রপ্তানি আয় কম হচ্ছে। ফলে অর্থবছরের শুরু থেকেই বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৫৯ কোটি ডলার। একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতিও ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৫৯২ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ (৯.৫৮ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ১ লাখ আড়াই হাজার কোটি টাকা।

অক্টোবর মাস শেষে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৯৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ৪৩৩ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩৬ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৯৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭