ইনসাইড বাংলাদেশ

ফিরে দেখা: ধর্ষণ-নারী নিপীড়ন ও সামাজিক অবক্ষয়ের - ২০২২


প্রকাশ: 28/12/2022


Thumbnail

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, দেশে হত্যা-আত্মহত্যা, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস-ছিনতাই, প্রতারণা-ভূমিদখল, অর্থ ও মাদক পাচার, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি, কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধমূলক অপতৎপরতা দ্রুতই বৃদ্ধি পেয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দৃশ্যত বহুলাংশে স্বাভাবিক থাকলেও উদ্ভূত বেপরোয়া ভয়ংকর সব অপরাধের কারণে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ উদ্বিগ্ন। নগর, শহর, প্রান্তিক জনপদে ধনী-গরীব নির্বিশেষে রাজনীতিক, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, পর্যটকসহ কেউই নানামাত্রিক অপরাধের কদর্য এ রাহুগ্রাস থেকে নিস্তার পাচ্ছে না।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে এমন অপরাধের মধ্যে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বর্তমানে ধর্ষণ একটি অন্যতম অপরাধে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেও একে অবদমন করা যাচ্ছে না।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২১ সালে ডিএমপির আট বিভাগে অপরাধের মামলা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৬১টি, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক নিয়ে। এরপর রয়েছে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা। ডিএমপি এলাকায় গত বছরে (২০২১ সালে) ১৬৬টি খুনের ঘটনা ঘটে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৫৩টি কম। কিন্তু ২০২২ সালে এ ধরণের অপরাধের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও জানায় পুলিশ। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে কয়েক বছর ধরে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও ২০২২ সালের শুরু থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে খুনের ঘটনা। গত ২ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে সাতজন করে মোট হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রায় চার শতাধিক।

পুলিশের দেওয়া তথ্যানুসারে, বিভিন্ন অপরাধে ২০২১ সালে মোট গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৩৬৯ এবং মামলা হয় ২২ হাজার ৬৭৩টি। ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছিল মিরপুর ও গুলশান থানায়। 

ডিএমপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপরাধের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে তেজগাঁও বিভাগের আওতাধীন এলাকায়। ওই এলাকায় ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, চুরি, গাড়ি চুরি ও মাদক উদ্ধারের ঘটনা বেশি ঘটেছে। ঢাকা বিভাগের অপরাধের এ চিত্র থেকে কিছুটা হলেও দেশের সামগ্রিক অপরাধের দৃশ্যাদৃশ্য সহজেই আঁচ করা যাচ্ছে, যা দেশের জন্য বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুলিশ বাহিনীর ভাষ্যমতে, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে, সামাজিক আধিপত্য বিস্তার-ব্যক্তিগত বিরোধ, জমিজমা দখল, পারিবারিক কলহ, আর্থিক লেনদেনে সমস্যা, মাদক এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক কারণে দেশজুড়ে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪৫ হাজার ১৪৬টি। ওই পরিসংখ্যান মতে, দেশে ২০২১ সালে ৩ হাজার ৪৫৮টি, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৫৩৯টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫৩টি, ২০১৮ সালে ২ হাজার ৬১৭টি এবং ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৫৪৯টি হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। এ সকল বছরগুলোর তুলনায় ২০২২ সালে এমন অপরাধ এবং মামলার সংখ্যা অনেক বেশি বলেও জানায় পুলিশ। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন, জানুয়ারি থেকে জুলাই - ছয় মাসে ধর্ষিত ৫৪৬:

চলতি বছরের ৫ জুলাই বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ধর্ষিত হয়েছে ৪৭৬ নারী। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের পর খুন হয়েছে ২৪ এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ছয়জন। এছাড়া ৭২ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। 

ওই প্রতিবেদনে প্রকাশিত জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে ৩৭টি, চট্টগ্রামে ২৭, গাজীপুরে ২২ ও নোয়াখালী জেলায় ঘটেছে ১৫টি। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চলতি বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনের  তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।

এদিকে, ২৭ মার্চ ২০২২ তারিখ গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে ২০২১ সালে দেশে মোট ১ হাজার ১১৭ শিশু ধর্ষণের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, একক ধর্ষণের শিকার ৭২৩ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১৫৫ জন, প্রতিবন্ধী শিশু ১০০ জন এবং অন্যান্য ১৩৯ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। 

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ২৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।

জানা গেছে, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি। একই অভিযোগে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫টি এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি আব্দুল আওয়াল নয়ন খান বলেন, দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

এদিকে, নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা ও ধর্ষণ ঠেকাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করেছে সরকার। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সভা-সিম্পোজিয়ামসহ নানাবিধ আয়োজন, কর্মসূচি আয়োজিত হচ্ছে। তবুও থামছে না নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা। অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে এসব অপরাধ কমবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

তারা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। এর পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন তারা। ফলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার বানাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই আসছে সংবাদমাধ্যমে। এভাবে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে নারী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বিজ্ঞপ্তি, এপ্রিল, ২০২২:

চলতি বছরের শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই মোট ২৪৩ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮০ জন। শনিবার (৩০ এপ্রিল) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে ১২২ জন কন্যা নির্যাতন এবং ১২১ জন নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনাসহ মোট ২৪৩ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া গেছে। 

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, নির্যাতিতদের মধ্যে ৩৩ জন কন্যাসহ ৪৭ জন ধর্ষণের শিকার, ১৮ জন কন্যাসহ ৩০ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২ জন কন্যাসহ ৩ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। এ ছাড়াও ৬ জন কন্যাসহ ৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২ জন কন্যাসহ ৭ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে। ৭ জন কন্যাসহ ৯ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে ১ জন। ৩ জন অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে এবং এরমধ্যে ২ জনের অগ্নিদগ্ধের কারণে মুত্যু হয়েছে। ১০ জন কন্যাসহ ১১ জন অপহরণের ঘটনার শিকার হয়েছে। 

পাশপাশি ১ জন কন্যা অপহণের চেষ্টার শিকার হয়েছে। নারী ও কন্যা পাচারের ঘটনা ঘটেছে ১টি। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ জন, এরমধ্যে ৩ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১০ জন কন্যাসহ মোট ২৬ জন। ১০ জন কন্যা উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ২ জন কন্যা উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে। বিভিন্ন কারণে ৩ জন কন্যাসহ ২৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ছাড়াও ১ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ৪ জন কন্যাসহ ১৫ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ৯ জন কন্যাসহ ১৮ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ২ জন কন্যাসহ ৩ জন আত্মহত্যার প্ররোচনার শিকার হয়েছে। ১ জন ফতোয়ার শিকার হয়েছে। ২ জন পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২ জন কন্যাসহ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে ৪ জন। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ১টি। এ ছাড়াও ১ জন কন্যাসহ ৩ জন বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

ভার্চুয়াল জগতে নিপীড়ন ও সাইবার বুলিং প্রসঙ্গ:

বর্তমান সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি বিষয় ইন্টারনেট ব্যবহার। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভার্চুয়াল জীবনে মানুষের প্রবেশগম্যতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে -এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আজকের দিনে যখন প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের জগত আমাদের জন্য উন্মুক্ত, সেই সময় সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে উন্নত ও নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া।

এই ডিজিটাল জীবনাচরণের একটি অন্যতম বড় নেতিবাচক দিক হলো ডিজিটাল প্রযুক্তিমাধ্যম ব্যবহার করে কাউকে হয়রানি করা, ভয় দেখানো, রাগানো, লজ্জা দেওয়া, অসম্মান করা, মার্জিত ভার্চুয়াল ভাষায় যাকে বলে ‘সাইবার বুলিং’। এর সবচেয়ে বড় অসুবিধাটি হলো অপ্রকাশ্যে হেনস্তাকারী পরিচয় গোপন করে এই কাজগুলো করতে পারেন। 

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণামতে, সাইবার বুলিংয়ের ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যার বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সাইবার বুলিং’ এক আতঙ্কের নাম। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, নানামুখী যোগাযোগের বিকাশ, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিতের অভাবকে এই সমস্যার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করেই সাইবার অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে। সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) গবেষণা বলছে, সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশই ভুগছেন সাইবার বুলিংয়ের কারণে। 

২০২০ সালের নভেম্বরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম শুরু করে, যেখানে দেখা যায় প্রথম বছরে ১৭ হাজার ২৮০ জন নারী অভিযোগ করেছেন, যারা প্রত্যেকেই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। 

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের এক গবেষণামতে ৫০ শতাংশের বেশি নারী অনলাইনে সহিংসতার শিকার হন, এর মধ্যে ৬২ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে, যার ৫৫ শতাংশই ছাত্রী।

বিব্রতকর মেসেজ, হুমকিযুক্ত ইমেইল, মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানো, ইনবক্সে আপত্তিকর ছবি, ভিডিও, ফেইসবুকে মিম তৈরি ও প্রচার করে নারী ও শিশুদের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠছে ইন্টারনেট। অনেকে স্রেফ মজা করার জন্য সাইবার বুলিং করে থাকেন, যা ব্যক্তির অধিকারের চরম লঙ্ঘন।

আলোচিত ঘটনা: কেইস স্টাডি-১

রাজধানীর শুক্রাবাদে এক বিউটিশিয়ানকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গত ১১ অক্টোবর। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বখে যাওয়া দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে শেরেবাংলানগর থানা পুলিশ। এরা হলেন -মো. রিয়াদ (২৪) ও ইয়াছিন হোসেন ওরফে সিয়াম (২৩) । চলতি বছরের অক্টোবর মাসে, পরিবারের সাথে রাগ করে শুক্রবার (৭ অক্টোবর) বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ১৬ বছরের এক তরুণী। নেত্রকোনা জেলার কোনো একটি রেলষ্টেশন থেকে তিনি ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে করে রাত ৮টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। পরে ট্রেনের বগির ভেতরে নিয়ে ভিকটিমের মুখ চেপে ধরে তাকে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ৫জনকে গ্রেফতার করলেও মূলহোতা পলাতক। 

এদিকে, ডেমরায় ১৯ বছর বয়সী এক তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর বিকেলের দিকে ডেমরার কোনাপাড়া এলাকার কাশবনে এ ঘটনা ঘটে।

আলোচিত ঘটনা: কেইস স্টাডি-২

স্বপ্ন ছিলো প্রিয় মানুষের সাথে ঘর বাঁধবেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী মঙ্গলবার বিকেলে (১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২) রাজশাহী থেকে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে নাটোরে বিয়ে করতে যান দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। কিন্তু বিধিবাম, সেখানে গিয়ে মুহিন নামের এক ব্যক্তির পাল্লায় পরেন তারা। পরে তার পরামর্শে মিথিলা নামের এক মেয়ের বাড়িতে যান তারা। এ সময় মিথিলার পরিচিত পাঁচ জন মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। পরে রাতে মিথিলা ওই স্কুলছাত্রী ও তার প্রেমিককে ছেড়ে দিলে তারা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে পুলিশ মিথিলা ও তার স্বামীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। বাকি দুই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলেও জানায় পুলিশ।  

আলোচিত ঘটনা: কেইস স্টাডি-৩

চলতি বছর ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিনে যৌন নিপীড়ন মামলায় এক সংগীত শিক্ষককে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। রাঙামাটির আসামবস্তি এলাকায় সংগীত শিক্ষার সুযোগে ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের মামলায় শিক্ষক রণজিত পাটোয়ারীকে আট বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয় আদালত। বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ ই এম ইসমাইল হোসেন এ রায় দেন।

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ থেকে ভিকটিম আসামির ভাড়া বাসায় গান শিখতে গেলে প্রায় এক বছর বিভিন্ন অজুহাতে যৌন নিপীড়নের চেষ্টা করেন ওই শিক্ষক। পরে ২০২১ সালের ১০ মার্চ সকালে ভিকটিমের সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে পুরো ঘটনা স্থানীয়দের জানানোর পাশাপাশি ওই দিনই রাঙামাটির কোতোয়ালি থানায় মামলা করে পরিবার। রাতেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আদালতে শুনানি শেষে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১০ ধারায় আট বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দু’বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করে।

আলোচিত ঘটনা: কেইস স্টাডি-৪

চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ভোলার চরফ্যাশনে বকুল বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধূকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় বকুলের বড় বোন মুকুল বেগমকেও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়। মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) রাতে চরফ্যাশনের মুজিবনগর ইউনিয়নের সিকদারচরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত বকুল সিদকারচর গ্রামের মো. আলম বাচ্চু মেলকারের স্ত্রী।

এদিকে বুধবার (৩০ নভেম্বর) সকালে নিহত বকুলের বোন মুকুল বেগমকে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে চরফ্যাশন হাসপাতাল ভর্তি করেন স্থানীয়রা। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নিহত বকুলের স্বামী মো. আলম বাচ্চু বলেন, প্রতিপক্ষ আসলাম, সোহেল, মিঠু ও জুয়েলদের সঙ্গে তাদের চরের জমি নিয়ে বিরোধ চলছে। দীর্ঘদিনের মামলা-মোকদ্দমাও রয়েছে। প্রতিপক্ষরা জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। ঘটনার রাতে তিনি চর থেকে এসে ভোলায় জজ আদালতে মামলার হাজিরা দেয়ার জন্য চরফ্যাশনে আত্মীয়র বাড়িতে ছিলেন। গভীর রাতে প্রতিপক্ষরা বসতঘরে ঢুকে তার ঘুমন্ত স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীদের শব্দ পেয়ে তার স্ত্রীর বড় বোন মুকুল বেগম ঘুম থেকে উঠে বোনকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে তাকেও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়। খবর পেয়ে স্থানীয় দুলারহাট থানার পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে। ঘটনার পরপরই অভিযুক্তরা আত্মগোপনে চলে যান। 

চলতি বছরে খুন, ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন, সাইবার বুলিংসহ এমন অনেক অপরাধের ঘটনাই গণমাধ্যমে হরহামেশাই প্রকাশ পাচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০২২ সালে ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের মতো অপরাধ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলেই জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী, পুলিশ এবং বিশেষজ্ঞরা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭