ইনসাইড বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ: বিশ্বে রোল মডেল


প্রকাশ: 01/01/2023


Thumbnail

প্রতি বছর গড়ে সোয়া ৩৩ কোটির বেশি পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করছে সরকার। এ বছর (২০২৩ সাল) সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৩৫ কোটি বই বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। যার দাম হবে হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত এ পরিমাণ বই বিশ্বের কোনো উন্নত রাষ্ট্রও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করতে সক্ষম হয়নি। এজন্য বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল বলছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদরা।

শিক্ষাবিদরা জানিয়েছেন, ‘বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ’, ‘বই উৎসব’-এই ধরনের নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই, যেখানে বিনামূল্যে ছেলে মেয়েদের পাঠ্যবই দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখাপড়ার জন্য এ পর্যন্ত ৪ কোটির অধিক ছেলে মেয়েকে বিনামূল্যে বই দিয়েছেন। যা বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

জানা গেছে, ২০০৯ সালের আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়ুয়া সব শিক্ষার্থী নতুন বই থেকে বঞ্চিত হতো। সাধারণত দুই-তিনটি নতুন বইয়ের সঙ্গে পুরনো বই মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হতো। সব বই পেতে মার্চ পর্যন্ত সময় গড়িয়ে যেতো। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়তো। এখন সময় বদলে গেছে। বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেয়ায় পড়ালেখায় গতি ফিরেছে। নতুন বই ও উপবৃত্তি দেয়ায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও কমে এসেছে। বর্তমান সময়ে প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ শিশুকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন অভিভাবকরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিবছর বিনামূল্যের বিপুল বই ছাপাতে দেশীয় মুদ্রণ শিল্পও মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে অন্যতম বৃহৎ একটি অর্জন কোটি কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব শিক্ষার্থীকে নতুন পাঠ্যবই দেয়া শুরু হয়। প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীদের মাঝে সোয়া ৩৩ কোটির বেশি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। গত ১২ বছরে এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে সারাবিশ্ব যখন ঝুঁকির মুখে তখন সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হয়েছে। এটি বিশ্বের কোনো উন্নত দেশ করতে পারেনি। এটি একটি বিশ্ব রেকর্ড। এ বছর ২০২৩ সালেও বছরের প্রথম দিন ‘বই উৎসব-২০২৩’ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে সরকার ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হলো নতুন বই।  

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ১২ বছরে ৩৬৫ কোটি ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮১টি বিনামূল্যের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চার কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বিনামূল্যের বই দেয়া হয়েছে।

এনসিটিবি সূত্র আরও জানায়, সরকার ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাঝে তাদের নিজেদের ভাষায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করেছে। চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা -এ পাঁচ ভাষার শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরে তাদের মাতৃভাষায় বই ছাপানো হয়। এছাড়া দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে ব্রেইল বই দেয়া হচ্ছে।

এনসিটিবির সূত্রমতে, শিক্ষাবর্ষসহ (২০২০ সাল) ১১ বছরে মোট ৩৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৮৩ হাজারের কিছু বেশি বই দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। বই দিতে এখন প্রতিবছর সরকারের খরচ হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। শুধু ২০২১ সালের জন্য খরচ হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিনা মূল্যে বই দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি সারা বিশ্বে একটি বিরল ঘটনা। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার বলেছেন, ‘তিনি যখন ইউনেসকোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যেতেন, তখন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বিনামূল্যে এতো বিপুল পরিমাণ বই বিতরণের তথ্য শুনে অবাক হতেন এবং তাঁরা বলতেন, বিনা মূল্যে এতো বই আর কোথাও দেওয়া হয় না।’

সবাইকে একসঙ্গে বিনামূল্যে বই দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য যেমন কমছে, তেমনি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। আবার ঝরে পড়াও কমছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক-দুই স্তরে বিনামূল্যের বই দেওয়া শুরুর ১১ বছরের মাথায় দেড় কোটির বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। তবে বিনামূল্যে বই দেওয়ার পাশাপাশি উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিও শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কারণ বলে জানিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে প্রাথমিক স্তরে অর্ধেক বই বিনামূল্যে দেওয়া হতো। বাকি বই কিনে পড়তে হতো। আর মাধ্যমিক স্তরে সব বই কিনতে হতো। তখন শিক্ষার্থীদের বই পেতেই বছরের কয়েক মাস চলে যেত। অনেকে সামর্থ্যের অভাবে কিনতেও পারত না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হতো। ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেওয়া শুরু করে সরকার। এখন প্রাক-প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর (৫টি ভাষায় রচিত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো বইয়ের মান এবং বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমনকি, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ধারার বইয়ের বিষয়বস্তু পরিবর্তন নিয়েও আন্দোলন ও সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই বছরের শুরুতে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যতদিন থাকবে, ততোদিন অবশ্যই এই ‘বই উৎসব’কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তারা। 

সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদরা আরও বলছেন, বিনামূল্যে বই দেওয়ার আগে দেখা যেত, অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো সব শিক্ষার্থীর বই পেতে জুন পর্যন্তও সময় লেগে যেত। কিন্তু বিনামূল্যে বই দেওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য কমে গেছে। ঝরে পড়াও কমছে (এখন প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৮ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৪০ শতাংশের কম)। আরেকটি বিষয় হলো, আগে দেখা যেত, শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হতেই এক-দুই মাস চলে যেত। এখন বছরের শুরুতেই শ্রেণি কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হচ্ছে। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের বড় কারণ বিনামূল্যে বই দেওয়া। শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে, সেই কথা বিবেচনা করে শিক্ষাক্রমে নতুন করে পরিবর্তনও আনা হয়েছে।

এদিকে এনসিটিবি সূত্র জানায়, বিনামূল্যে বই দেওয়ার শুরুর বছর ২০১০ সাল। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসার ইবতেদায়ি, দাখিল, দাখিল (ভোকেশনাল), এসএসসি (ভোকেশনাল) স্তরে মোট শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ জন। তখন তাদের জন্য ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই ছাপানো হয়। এরপর দু-এক বছর ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই শিক্ষার্থী ও বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭