ইনসাইড আর্টিকেল

খুন, ধর্ষণ এবং সামাজিক অবক্ষয়, কেমন যাবে ২০২৩ সাল?


প্রকাশ: 06/01/2023


Thumbnail

সাম্প্রতিককালে পত্রিকার পাতা কিংবা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধির প্রবণতা চিন্তিত করে তুলেছে সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিজ্ঞানীদের। প্রতিদিনই একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ ব্যাপারে যতই সরব হোক না কেন, ঠিক উল্টো চিত্র পাওয়া যায় রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালকদের কাছ থেকে। স্বাধীনতার ৫১ বছর ধরে যে চিত্র সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জায়গা করে নিয়েছে - তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর কি হবে ২০২৩ সাল? 

দেশে হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, প্রতারণা, ভূমিদখল, অর্থ ও মাদক পাচার, দুর্নীতি, চাঁদা ও টেন্ডারবাজি, কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরামূলক অপতৎপরতার রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাচ্ছে না শান্তিকামী সাধারণ মানুষ। এ ধরনের সামাজিক অপরাধ, সামাজিক অবক্ষয় দ্রুতই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ২০২২ সালে এ ধরনের অপরাধ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছিল বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিন্তু কেমন যাবে ২০২৩ সাল? 

প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে, নারী ঘরে, বাইরে কর্মস্থলে, বাসে, ট্রেনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয় নির্যাতনের পর তাকে হত্যাও করা হচ্ছে। এসব ঘটনার পরও সুষ্ঠু ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা করা যায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। নাজনীন ধর্ষণ মামলার চূড়ান্ত রায় পেতেও তার প্রভাবশালী ধনাঢ্য পরিবারকে এক যুগেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাহলে প্রত্যেক নির্যাতিতা নারী ও শিশুদের সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার আশা করা যাচ্ছে কি? এ ধরনের বিচারহীনতা, অপরাধ থেকে পরিত্রাণের উৎস কি হতে পারে? কেমন হতে পারে ২০২৩ সাল?

এসব নিয়ে কথা হয়েছে একাধিক অপারাধবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের সাথে। তারা বলছেন, এ ব্যাপারে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সক্রিয় ভূমিকা থাকলে ২০২৩ সাল হতে পারে শান্তির বছর।   

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও হত্যা, অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, দাহ্য পদার্থ দিয়ে ক্ষতি করা, ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানির মতো অপরাধ রয়েছে।

 এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন হয় না। প্রধানমন্ত্রী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা আছে।’

সাধারণত নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা গুরুতর হলে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ৯টি পত্রিকা ও কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে তথ্য নিয়ে জানিয়েছে, চলতি বছরের (২০২২ সাল, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর) গত ১১ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৩ হাজার ১৮৪টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশই ধর্ষণের খবর।

এ ছাড়াও, ২০২২ সালে অনলাইনেও নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভুয়া আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেলিং, মুঠোফোনে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন ৮ হাজার ৭১৫ নারী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬৬১টি অভিযোগ এলেও গত নভেম্বরে এসেছে ৮২৬ অভিযোগ।

অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব অভিযোগগুলো তাৎক্ষনিক আমলে নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করাসহ - তা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হলে অপরাধে জড়িয়ে যেতে মানুষ অনুৎসাহিত হবে, ভয় পাবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান এবং তার প্রচার গণমানুষের মনে আস্থার সঞ্চার করবে। ফলে মানুষ শুধু অভিযোগ করেই ক্ষান্ত হবে না, অভিযোগের পর বিচার নিশ্চিত হলে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করবে। তাতে করে সামাজিক অপরাধগুলো দিনে দিনে হ্রাস পাবে। 

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কেন এই নৈতিক অবক্ষয়? আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি? না, আমরা কখনো মূল বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি না। যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন একটু হইচই করি। তারপর আবার ঘুমিয়ে যাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৌড়ঝাপ, বুদ্ধিজীবী মহলের বিভিন্ন পরামর্শ এবং মিডিয়াকর্মীদের নতুন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক নেতাদের মায়াকান্নার বক্তব্য আর সরকারের আশ্বাস-এক সময় সবই স্তিমিত হয়ে যায়; নতুন আরেকটি ঘটনাচক্রের কারণে। এভাবেই চলছে খুন, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো। যেন কোনো ক্যামেরায় বন্দি করা চলচ্চিত্র। একের পর এক প্রস্ফুটিত হয়ে ভাসছে সাদা পর্দায় আর আমরা দর্শনার্থী হিসেবে উপভোগ করছি। কখনো মনের গহিনে দু’এক ফোঁটা চোখের জল ফেলছি এতোটুকুই! আবার ভুলে যাচ্ছি সব কিছু নিজের অজান্তে।

সমাজবিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, এসব ঘটনা প্রমাণ করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ঠিক আগের মতো নেই। প্রত্যেকটি অঙ্গন নৈতিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাসে পতিত হয়েছে। প্রত্যেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের জন্য উঠেপড়ে লেগে আছে। শুধু চাই চাই চাই; চাওয়া-পাওয়ার কোনো শেষ সীমানা নাই। যত পাই, তত চাই আর খাই। হালাল ও হারাম কোনো বাছবিচার নেই। কী মোল্লা-মুন্সি, পীর-বুজুর্গ, গুরু-শিক্ষক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অফিস পিয়ন সবারই একটি মাত্র চাওয়া- অতিরিক্ত কি পকেটে আসল? মাসিক বেতন সেটা তো অপশনাল বিষয়, বাড়তি পাওয়াটা যেন তাদের অধিকারে পরিণত হয়েছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের নিকট প্রাইভেট অথবা কোচিং না করলে পাসের নিশ্চয়তা নেই। অফিস কাছারিতে বাড়তি টাকা না দিলে ফাইল চলে না। পীরের দরবারে নজরানা না দিলে নেক নজর পড়ে না। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন সবারই একটি চাওয়া- ভালো খাবার দাও, ভালো কাপড় দাও, ভালো বাসস্থান দাও। শুধু দাও আর দাও। কিন্তু কেউ একবারও বলে না যে, প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা কম দাও; তবে হালাল আয়-রোজগার থেকে দাও। এই সর্বস্তরে লোভ নামক ভাইরাসটি বাসা বেঁধেছে; সে তো সবাইকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে।

তাঁরা বলছেন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমিক-কুলি, রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ড্রাইভার-মালিক, যে যে স্তরে রয়েছে সবাই যদি আত্মবিবেচনায় বিচার করত, তার নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যটা কী? নাগরিক হিসেবে আমরা যারা বসবাস করছি আমাদেরই বা কতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তাহলে হয়তো আজকের মতো নৈতিক অবক্ষয় এতোটা হতো না। আমরা এতো নিচে নেমে যেতে পারতাম না। কন্যার বয়সী মেয়েকে ধর্ষণ; তারপর ধামাচাপা দেয়ার জন্য নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করা। প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে মানুষকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করতে বিবেক বাধা প্রদান করত। লোভ-লালসা আমাদের বিবেক নামক জিনিসটাকে তছনছ করে দিয়েছে। বিবেকহীন মানব রাজ্যে বিবেকবান মানুষ বোবার মতো বসবাস করছে। কখনো পুতুল হয়ে চলাফেরা করছে। অপরাধ হচ্ছে হতে দাও, কোনো প্রতিবাদ নেই। অপরাধের এই জগতে সবাই দর্শক। কিন্তু এভাবে দেশ বা সমাজ বা রাষ্ট্র চলতে পারে না। রাষ্ট্রের যেমন এসব বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে, তেমনই দায়িত্ব রয়েছে সমাজের প্রতিটি মানুষের। মানুষের ভেতরের বিবেককে জাগ্রত করা না গেলে সামাজিক এসব অপরাধ, সামাজিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিজ্ঞানীরা আশা প্রকাশ করছেন, রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ এবং গণমাধ্যম যদি সোচ্চার হয় তবে ২০২৩ সাল হবে সামাজিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের বছর। এ ছাড়াও, রাজনৈতিক নেতা এবং সামাজিক নেতা, সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজেদের বিবেককে যদি জাগ্রত রাখেন,তবেই ২০২৩ সাল হবে খুন, ধর্ষণ, নারী নীপিড়নসহ বিভিন্ন সামাজিক ভয়ঙ্কর অপরাধ থেকে মুক্তির বছর। তাঁরা বলছেন, সামাজিকভাবে যদি আমরা একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দেই, যদি পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি করি, লোভ-লালসা মুক্ত হয়ে ত্যাগী, নির্লোভ, বিবেকবান হতে শিখি, তবেই অপরাধমুক্ত সুন্দর, শান্তিময় হবে সমাজ। ২০২৩ সালে আমরা একটি সুন্দর শান্তিময় অপরাধমুক্ত, সামাজিক অবক্ষয়মুক্ত দেশ প্রত্যাশা করছি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭