ইনসাইড বাংলাদেশ

বাংলাদেশ হবার স্বপ্ন দেখে পাকিস্তান


প্রকাশ: 06/01/2023


Thumbnail

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর এসে আজও কারও কারও আক্ষেপ শোনা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সবরকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পরও সুযোগ পেয়ে কিছু মানুষ পাকিস্তানকে বাংলাদেশের চেয়ে উত্তম মনে করেন। নির্লজ্জের মতো পাকিস্তানপ্রেম দেখান প্রকাশ্যে।

এই তাদের পাকিস্তানপ্রেম যে কতটা ভ্রান্ত ধারণার উপর জন্মে আছে তার জবাব আজ বিভিন্ন ভাবে দেয়া যেত পারে। অথচ একদিকে ওরা যখন পাকিস্তানের পতাকাকে নিজের প্রতীক হিসেবে মনে করে, অইদিকে ওই সময়ই পাকিস্তানের মানুষ মনে করে- তারা যদি বাংলাদেশের মতো হতে পারতো। বাস্তবতার নিরিখে আজ তারা বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং প্রকাশ্যেই কামনা করে এমনটা। দুঃখজনক হচ্ছে- বাংলাদেশের কিছু বিভ্রান্ত মানুষ সেই পাকিস্তানকেই স্বপ্নের দেশ হিসেবে ভাবতে আরাম পায়।

বাংলাদেশকে দমন করার প্রধান লক্ষ্য নিয়ে নীল নকশা করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অথচ নিয়তি আজ সব বদলে দিয়েছে। আলী জিন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সর্বশেষ ইয়াহিয়া খান, প্রত্যেকেরই মানসিকতা ছিল একই। কিন্তু সফল হতে পেরেছে কেউ? তাদের কারণেই পাকিস্তান ভেঙেছে। পাকিস্তান ভাঙায় পাকিস্তানিদেরই কপাল ভেঙেছে। বাঙালি ঠিকই তার নিজের মেধা মনন এবং আন্তরিকতা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

এবার দেখা যাক, কোন কারণে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশি হতে চায়। মোটা দাগে যদি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে তুলনা করা হয় তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পাকিস্তানের ৯ কোটি মানুষের মধ্যে ৫ কোটিরও বেশি অধিবাসী ছিল বাঙালি। এটা ১৯৬১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী। পাকিস্তানের উন্নয়ন যাত্রায় বাংলাদেশকে তথা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানকে দ্বিতীয় স্তরে মূল্যায়ন করা হতো। সেই পাকিস্তান আজ জনসংখ্যার চাপে চ্যাপ্টা হওয়ার পর্যায়ে পড়েছে।

পাকিস্তান বর্তমানে জ্বালানি খাতের ঋণের জালে জর্জরিত। সেই সঙ্গে দেশটির অর্থনৈতিক সংকটও দিন দিন বাড়ছে। দেশটির রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ডিসেম্বরে ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে দেশটির রিজার্ভ। হিসাব অনুযায়ী, গত আট বছরের মধ্যে রিজার্ভ তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই রিজার্ভ দিয়ে এক মাসের মতো পণ্য আমদানি করা যেতে পারে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে যে ঋণ আসার কথা ছিল, তা–ও দেরি হচ্ছে।

পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ তার জিডিপির ৪৭ শতাংশ। প্রতি বছর পাকিস্তানের লেনদেনের ভারসাম্যের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে। উপরন্তু, সরকারি বাজেটের ক্রমবর্ধমান বিরাট অংশ তাদেরকে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে বরাদ্দ করতে হচ্ছে।

পাকিস্তানের পত্রিকা ডনের খবরে বলা হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির জ্বালানি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২৫৩ ট্রিলিয়ন (পাকিস্তানি) রুপি। বছর শেষে এটা বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ৪৩৭ ট্রিলিয়ন রুপি। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি রুপি বেড়েছে। ফলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের দেনা মেটাতে পারছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানি সরবরাহকারীদের দেনা মেটাতে পারছে না।

রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে শুরু কওরে অর্থনৈতিক সঙ্কট, সবকিছু মিলিয়ে বিপর্যস্ত পাকিস্তান। অন্যদিকে এর তুলনায় বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত উন্নয়তির সূচকে প্রতিনিয়ত নিজেদের অবস্থান শক্ত কওরে যাচ্ছে।

আর্থসামাজিক নানা খাতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থানের পার্থক্য তুলনা করলে, তাতে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ ৭৫ শতাংশ দরিদ্র ছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ ৪৫ শতাংশ ধনী। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে এক কোটি বেশি ছিল। আজকে ৫১ বছরে বাংলাদেশ বলতে পারে, তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখন পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৩ কোটি আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে তাদের উৎপাদনমুখী সমাজ তৈরি করতে পারেনি পাকিস্তান।

২০২১ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা চলতি বছর ৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। আর পাকিস্তানের রপ্তানি আয় ছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭২০ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ১ হাজার ৪৩০ মার্কিন ডলার। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের তুলনায় তাদের উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। উন্নয়ন অভিযাত্রায় বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ার কারণে তাদের গড় আয়ুতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে গড় আয়ু যখন ৭৩ বছর সেখানে পাকিস্তানে গড় আয়ু ৬৭ বছর।

এছাড়া চলতি বছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হচ্ছে ৪১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ৩৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬ শতাংশ আর পাকিস্তানের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, যা বেড়ে এখন ২১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানের রুপির তুলনায় বাংলাদেশের টাকা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী।

তবে এটা ঠিক পাকিস্তান কয়েক বছর ধরে বেসামরিক প্রশাসন চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। তবে নেপথ্যে সামরিক বাহিনীর করুণা ওপেন সিক্রেট। তারপরও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কিছুটা হলেও অর্জন করেছে। যে কারণে তাদের এগিয়ে যাওয়ার সূচনা হয়েছে। যদিও সেখানকার বেসামরিক সরকারকেও সামরিক বাহিনীর করুণা গ্রহণ করতে হয়। এটা পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরাও মনে করেন।

বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। তাছাড়া উচ্চ সাক্ষরতার হারও রয়েছে।পাকিস্তানে নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নেও ধর্মীয় গোঁড়ামি কাজ করে। এখনও তারা নারীকে গৃহপালিত মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশ নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ মনে করে দেশের অর্ধেক মানুষ নারীকে বাদ দিয়ে কোনো দেশের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তান চিন্তা করে বিপরীত।

নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও উপরে। জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের নারী সদস্যের হার ২০.৩ শতাংশ। পাকিস্তানে তার চেয়ে কম। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ মেয়েদের শিক্ষা সুবিধা। অনেক বছর ধরে ছাত্রীদের লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশে প্রণোদনা হিসেবে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হলেও বাল্যবিবাহ কমেছে। ছাত্রীদের একটা পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে এর অগ্রগতি সম্পর্কে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীর হার ছিল ২৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এসে সেই হার ৫১ শতাংশ হয়েছে। নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করার কারণে পাকিস্তান শাসনামলের চেয়ে নারী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে কারণে পাকিস্তানিরা এখন বলছে- আমাদের সিঙ্গাপুর কিংবা নিউইয়র্ক নয় বাংলাদেশ বানিয়ে দাও।

বাংলাদেশের নারীদের ৩৬ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এ অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানের ৫৯। বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।

কীভাবে তারা বাংলার সম্পদ লুট করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের কথা ভেবেছিল। ভাবছি ঐতিহাসিক ৬ দফার কথা। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে একই দেশে দুই চিত্র দেখা যেতো। এখন অন্তত দুটি দেশের চিত্র। পাকিস্তান থেকে সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের ঋণ শোধ করছে বাংলাদেশ, আর পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিচ্ছে-নিপীড়নের ফল কী হতে পারে। পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না বলে বিশ্বাস। এইত কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও কলাম লেখক সাহিবজাদা রিয়াজ নূর। ‘বাংলাদেশের নেতৃত্বের কাছ থেকে গ্রহণীয়’ শিরোনামের এক নিবন্ধে লিখেছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যার কৃতিত্ব দেশটির নেতৃত্বকে দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছুই পাকিস্তানের নেতৃত্ব শিখতে পারেন। তবে তাদের কাছে সবার আগে গ্রহণীয় হওয়া উচিত শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি। এটাই এখন প্রতিরক্ষা ও গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭