বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা তিনি। বলা যায় তার সময়কালের অন্যতম গুনী অভিনেতাও। কোনো ফিল্মি ব্যকগ্রাউন্ড ছিল না, তবে ভাগ্য তাকে নিয়ে এসেছে চলচ্চিত্র অঙ্গনে। ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছেন বলিউডের মহা সাম্রাজ্যে। তিনি ইরফান খান। বলিউডের প্রয়াত অভিনেতা, অভিনয় জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আজ তার ৫৬তম জন্মদিন।
১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি জয়পুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইরফান। একজন ক্রিকেটার হবার ইচ্ছা থাকলেও তিনি জীবনের স্রোতে চলে আসেন অভিনয় জগতে। যখন তিনি মাস্টার্স পড়েছেন, তখনই দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে বৃত্তি পান। কিন্তু মুম্বাইতে তাঁর প্রথম চাকরি ছিল একজন এসি মেকানিক হিসেবে। অনেকে বলেন চাকরির প্রথম দিকে তিনি নাকি রাজেশ খান্নার বাড়িতে যেতেন এসি সারাতে। টেলিভিশন দিয়ে নিজের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ‘চাণক্য ‘ভারত এক খোঁজ ‘সারা জাহা হামারা ‘বানেগি আপনি বাত ‘চন্দ্রকান্তা’ এবং ‘ষ্টার বেস্ট সেলার্স’-এর মত ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন তিনি।
মীরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে'-তে একটি সংক্ষিপ্ত ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় দিয়ে বলিউডে যাত্রা শুরু হয় ইরফান খানের। এর পরে ১৯৯৮ সালে ‘এক ডক্টর কি মউত’ এবং ‘সেই এ লং জার্নি’-এর মতো কিছু সিনেমায় কাজ করেন ইরফান। ‘এক ডাক্তার কি মউত’ সিনেমাটিতে অভিনয় করে সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। তবে সেখান থেকেই তার সোনালি দিন শুরু হয়নি। এরপরেও তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তবে সেগুলো তার ক্যারিয়ারে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। অনেক ব্যর্থ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
ইরফান ক্যারিয়ারে আসল সফলতা পান আসিফ কাপাডিয়ার ফ্লিক ‘দ্য ওয়ারিয়র’-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে। সিনেমাটি একটি ঐতিহাসিক ফ্লিক ছিল যা মাত্র ১১ সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। এটি ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পায়। সিনেমাটি ইরফানকে বিখ্যাত এবং পরিচিত মুখ করে তোলে। ২০০৩-০৪ সালে তিনি অশ্বিন কুমারের শর্ট ফিল্ম ‘রোড টু লাদাখ’-এ অভিনয় করেছিলেন যা তুমুল আলোচনায় ছিল। এরপর সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ হিন্দি চলচ্চিত্র হিসাবে নির্মিত হয়েছে যেখানে ইরফান খান প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এরপর তাকে চলচ্চিত্র 'মকবুল'-এ দেখা যায়, যেটি শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ অবলম্বনে নির্মিত। সিনেমাটির জন্য তিনি দারুণ প্রশংসিত হন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে লাইমলাইটে চলে আসেন ইরফান। ‘রোগ ‘হাসিল ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’র মতো সিনেমায় কাজ করে তিনি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর ২০০৮ সালে ড্যানি বয়েলের অস্কার পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র 'স্লামডগ মিলিয়নেয়ার'-এ মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন এই প্রতিভাবান অভিনেতা। এরপর থেকেই ইরফান হয়ে উঠেন বলিউডের অন্যত প্রভাবশালী একজন অভিনেতা। ২০১২ সালে ‘পান সিং তোমার’ চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন অভিনেতা।
সাধারনত হলিউডের চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন যেকোনো বলিউড অভিনেতা। তবে ইরফান খান এদিকেও ছিলেন ব্যতিক্রম। ক্রিস্টোফার নোলানের মত পরিচালককে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ইরফান। নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমাটিতে একটি মাঝারি রোলের অফার অভিনেতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তখন। কারণ সেই সময় ‘লাঞ্চ বক্স’এবং ‘ডি ডে’ সিনেমায় অভিনয়ের কথা ছিল তাঁর। নিজের কথা কখনো হেরফের করেন না এই অভিনেতা। তবে হলিউডের অনেক সিনেমায় কাজ করেছেন ইরফান খান। ‘দ্য আমেজিং স্পাইডারম্যান ‘লাইফ অফ পাই’ এর মতো চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর অভিনয়ের তারিফ করেছিলেন জুলিয়া রাবার্টসের মত অভিনেত্রীও। এক অস্কার অনুষ্ঠানের রাতে জুলিয়া আলাদাভাবে তাঁকে ডেকে ‘নেমসেকে’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়ের সুনাম করেছিলেন। তিনি একমাত্র ভারতীয় অভিনেতা যিনি দুটো অস্কার পুরস্কার জয়ী সিনেমায় অভিনয় করেছেন।‘লাইফ অফ পাই’ এবং ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’।
২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই গুনী অভিনেতা। সহকর্মী থেকে শুরু করে সহ-অভিনেতা এবং পরিচালকদের কাছে তিনি আজও চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছেন। অসামান্য প্রতিভা এবং অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার কারণে দর্শকদের মনের মনি কোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রত্যেকটি সিনেমাই দর্শকদের মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছে। ‘পান সিং তোমার ‘পিকু ‘হিন্দি মিডিয়াম ‘তলোয়ার সব সুপারহিট সিনেমা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন অভিনেতা। তাঁর চলে যাওয়া, বলিউডের জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতি ছিল, যা আজও স্মরণ করেন বলিউড তারকারা।