ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার বিশেষ বিমানে দুই পুরনো বন্ধুর কূটনীতি


প্রকাশ: 10/01/2023


Thumbnail

বঙ্গবন্ধু ও ব্যানার্জীর মধ্যে ছিল পুরনো বন্ধুত্ব। ব্যানার্জীর পুরা নাম শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী। কলকাতায় জন্ম নেয়া একজন বাংলা ভাষী ভারতীয় কূটনীতিক। ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকায় ছিলেন পাঁচ বছর। তিনি তখন ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের রাজনৈতিক কর্মকর্তা। বন্ধুত্বের শুরুটা ১৯৬২ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তাঁর বাসভবন ছিল ইত্তেফাক অফিসের পাশের ভবন চক্রবর্তী ভিলায়। মধ্যরাতের পর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তিনি হতচকিয়ে  গেলেন। পাকিস্তানের একটি প্রদেশে কাজ করার জন্য অধিক সাবধানী চলাচলের নির্দেশনা ছিল কেন্দ্র থেকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দরজা খুললেন। অনুমান চৌদ্দ বছরের এক অতিশয় বিনয়ী এক বালক সালাম দিয়ে বললো, ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া এখুনি যেতে বলেছেন, যদি না তাঁর কোন সমস্যা থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি পাশের ইত্তেফাক ভবনে গেলেন। মানিক মিয়ার সাথে ব্যানার্জীর প্রথম সাক্ষাৎ। পাশে বসা দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক চিনতে কোন অসুবিধা হয়নি। তাঁকে অনেকবার দেখেছেন পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দিতে। প্রায় প্রতিদিন দেখেন সংবাদপত্রের পাতায়। তিনি আর কেউ নন। তিনি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু সেদিন ব্যানার্জীকে ডেকেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে বঙ্গবন্ধুর একটি চিঠি পৌঁছে দেয়ার জন্য। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের একটি রূপরেখা ও রোডম্যাপ বর্ণনা করে ভারত সরকারের কাছে সমর্থনের আবেদন জানিয়েছিলেন। মধ্যরাতে দু'ঘন্টা ব্যাপী এ বৈঠকের পর এ ইস্যুতে তাঁরা সমসাময়িক কালে আরো দুটি বৈঠক করেন। ২০১১ সালে প্রকাশিত "ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন ও পাকিস্তান" নামের বইতে শশাঙ্ক এস  ব্যানার্জী এসব তথ্য প্রকাশ করেন।

প্রায় নয় বছর দু বন্ধুর মধ্যে আর দেখা সাক্ষাৎ নেই। আবার দেখা ৯ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে হিথ্রো বিমানবন্দরে। যখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ব্যানার্জী কে দেখেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "ব্যানার্জী, আপনি এখানে ?" ব্যানার্জী তখন লন্ডনে ভারতীয় মিশনে কর্মরত। ব্যানার্জীকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হবার নির্দেশ দেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিনিস্ট্রি অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স এর পলিসি প্ল্যানিং মন্ত্রী দূর্গা দাস ধর, ইন্টেলিজেন্স প্রধান রামনাথ কাও, বিদেশ সচিব টি এন কাউল এবং 'র' এর দ্বিতীয় প্রধান কে শংকরণ নায়ার এর সাথে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত নেন। ইন্দিরা গান্ধীকে জানান হয়েছিল যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পরিচিত ও বন্ধু। তিনিই বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হবার উপযুক্ত ব্যক্তি। বিমান ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে কি কি ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে তার একটি দিক নির্দেশনা তিনি ব্যানার্জীকে দিয়েছিলেন। যেটিকে ব্যানার্জী তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিশন বলে বইতে বর্ণনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও ব্যানার্জী ছাড়াও সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ভিভিআইপি বিশেষ বিমানে ছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের লন্ডন মিশনের ওপর এক ফার্স্ট সেক্রেটারি ও ড কামাল হোসেন দম্পতি। একটি ইউটিউব ব্লগে ব্যানার্জী জানান, ইন্দিরা গান্ধী কখনো বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিব, মুজিবুর রহমান বা শেখ সাহেব বলতেন না। তিনি সব সময় 'বঙ্গবন্ধু' বলতেন।

বঙ্গবন্ধুর ফেরার কথা ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ বিমানে। সেভাবেই প্রস্তুতি চলছিল। আধ ঘন্টা ব্যাপী মুজিব-ইন্দিরা টেলিফোন সংলাপে এমনটাই জানান হয়েছিল। পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এর সাথে কথা বলে রয়েল এয়ারফোর্সের একটি মিলিটারি জেট এর ব্যবস্থা করেন। বিমান পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ইন্দিরা গান্ধী পরে গোপনে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে জানান। ব্যানার্জীর আসন ছিল বঙ্গবন্ধুর পাশে। ব্যানার্জী জানালার কাছে, বঙ্গবন্ধু তাঁর পাশে। প্রথমে অরেঞ্জ জুস পান ও হাসি ঠাট্টা ও খুনসুটি। দুজনেই মুখিয়ে আছেন যাঁর যাঁর কূটনীতির সফল বাস্তবায়নে। প্রথমেই শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু। দ্বিধাহীনভাবে ফিসফিসিয়ে বললেন, একটা উপকার করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, বিমান থেকে নামার সাথে সাথে ইন্দিরা গান্ধীর কানে পৌঁছাতে হবে যে তিনি তাঁর পরিকল্পনার অন্তত তিন মাস আগে ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা বৈঠকে তিনি বিষয়টি তুলবেন। ব্যানার্জী যদি আগে থেকে 'খোড়াখুড়ির' কাজটি করে রাখেন তাহলে আলোচনায় সুফল মিলবে। ব্যানার্জী  বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আপনি ছিলেন জেলে। আপনি জানলেন কিভাবে যে ভারত ৩০ জুন ১৯৭২ আর্মি ফেরত নিবে ? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, এডওয়ার্ড হিথ তাঁকে বলেছেন। আর্মি ফেরত নিতে দেরি করলে ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করবে। সেটির কারণেই এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর কূটনীতি। বিপাকে পড়ে গেলেন ব্যানার্জী। একটু নার্ভাস হলেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে দিল্লী এয়ারপোর্টে যে ডামাডোল হবে তার মধ্যে তিনি কেমনে জানাবেন উপর মহলকে।ভাগ্য সহায় ছিল। বিমান থেকে সকলে নেমে যাবার পর সবাই যখন রাষ্ট্রীয় আচারে ব্যস্ত, তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডি পি ধর ব্যানার্জীকে কাছে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেন, কি কথা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাথে। তিনি বঙ্গবন্ধু ও এডওয়ার্ড হিথের অভিপ্রায়ের  কথা জানালেন। ডি পি ধর বার্তা দিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে, তাঁর সাথে একটি জরুরি বৈঠক করার জন্য।

রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু আপ্যায়িত হন কলকাতা থেকে আনা নতুন গুড়ের সন্দেশ, সিঙ্গারা আর দার্জিলিং চা। এরই ফাঁকে ইন্দিরা গান্ধী বৈঠক সারলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে। বৈঠক করলেন ভারতের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে। ইন্দিরা-মুজিব বৈঠকে বঙ্গবন্ধু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি উত্থাপন করলে ভারত ৩১ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হয়। ব্যানার্জীর বর্ণনায়, 'এর আগে কখনো ভারতের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে এত গুরুত্বের সাথে এত দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।' বৈঠক শেষে প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু ব্যানার্জীর দুহাত ধরে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলেন, ব্যানার্জী, "আপনি ঠিক কইছেন। ইউ শুড বি আওয়ার্ডেড।" বঙ্গবন্ধু তাঁকে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে যেতে পারেননি। তবে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ অক্টোবর ২০১২ সালে তাঁকে অ্যাওয়ার্ড দেন।

অপরদিকে ব্যানার্জীর উপর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কিছু নির্দেশনা ছিল। নতুন সরকার পদ্ধতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কি ভাবছেন, সেটা জানা। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার হলে কে রাষ্ট্রপতি হবেন সেটা জানা। ব্যানার্জী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাধুবাদ জানান।  সংসদীয় সরকার পদ্ধতির আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু জানতে চান, আইডিয়া মিসেস গান্ধীর কিনা। বঙ্গবন্ধুর এ ধরনের জিজ্ঞাসায় ব্যানার্জী তাঁর বইতে লিখছেন, "মুজিবের ছেলেমানুষি দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।" প্রতিউত্তরে ব্যানার্জী বললেন, "হ্যা, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী আমাকে আপনার বিবেচনার জন্য এই পরামর্শ দিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নেবার ভার আপনার।"

বিমানের মধ্যে  বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জীকেও দাঁড়াতে বললেন। দাঁড়ালেন ভিভিআইপি ফ্লাইট এর অপর  তিন যাত্রীও।  বঙ্গবন্ধু গাইতে শুরু করলেন, "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।" প্রথমবার তিনি রিহার্সেলের মত করে গাইলেন। দ্বিতীয়বার তিনি গাইলেন বলিষ্ঠ ও অশ্রুসিক্ত আবেগে। ব্যানার্জীকেও সাথে নিলেন গাইতে। ব্যানার্জীও গাইলেন। এরপর সবাই বসলেন। বঙ্গবন্ধু ফিসফিস করে ব্যানার্জীকে বললেন, তিনি "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি" গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করতে চান। ব্যানার্জীর মতামত চাইলেন। তিনি সম্মত হলে বঙ্গবন্ধু বললেন, "যদিও ইতিহাসের কোথাও লিখিত থাকবে না কিন্তু ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমি (ব্যানার্জী) যেন জেনে রাখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করার সিদ্ধান্ত দুই পুরনো বন্ধুর নেয়া, 'আপনি এবং আমি'- রয়েল এয়ার ফোর্স এর লন্ডন থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটে।"



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭