প্রকাশ: 10/01/2023
৮ জানুয়ারি ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হবার
পর ১৯৭২ সালের ১০
জানুয়ারি পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে
এলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান।তাঁর ফিরে আসার মধ্য
দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী বাঙালি জাতির বিজয় পূর্ণতা পেলো।
বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে নয় মাস
পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা
হয়েছিল। লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলের অপরিসর একটি কুঠুরি ছিল
সেই বন্দির বাসস্থান। তাঁর জগৎ বলতে
সেখানে ছিল চার দেওয়াল,
একটি জানালা ও একটি উঁচু
বিছানা। ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বরের পর তাঁকে সরিয়ে
নেয়া হয় কারাগার থেকে
দূরে আরো দুর্গম জায়গায়।
২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে
রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পর্যায়ক্রমে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়
পাকিস্তানি শাসক।
একাত্তরে
পাকিস্তানের কারাভ্যন্তরে বন্দি ছিলেন ঠিকই; কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন
জানতেন না তিনি কোন
শহরে আছেন। কেবল জানতেন পাকিস্তানি
সামরিক বাহিনী তাঁকে বন্দি করে তৎকালীন পশ্চিম
পাকিস্তানের জেলে রেখেছে। কারাজগৎ
সম্পর্কে তাঁর ভালোভাবেই ধারণা
ছিল, কেননা আগেও তিনি কারাবন্দি
ছিলেন। তিনি কারাবাস সম্পর্কে
প্রায়শই বলতেন যে, প্রথম দফার
স্বল্পকালের কারাবাস ছাড়া তাঁকে কারাগারে
বরাবর নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রাখা হয়েছিল।
দৈহিকভাবে নির্যাতন করা না হলেও
নানাভাবে মানসিকভাবে হয়রানি করা হয় তাঁকে।কারা-কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহে বন্দির আচার-আচরণ সম্পর্কে
ইসলামাবাদে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতো। এই রিপোর্টে উল্লেখ
থাকতো তিনি কি খাবার
খেয়েছেন, তিনি কেমন ঘুমিয়েছেন,
সেলের মধ্যে এক দেয়াল থেকে
অন্য দেয়াল অবধি পায়চারি করেছেন,
কি করেননি। বন্দির কথাবার্তা সম্পর্কে জানতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব উৎসুক ছিলেন।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু সেলে প্রবেশকারী গার্ডদের
সালামের প্রতি-উত্তর দেওয়া ছাড়া সবসময় নীরবই
থাকতেন।
পাকিস্তানের
কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ এবং বাইরের দুনিয়ার
সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোনো যোগাযোগ না
থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ
ছিল- ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক
কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও
নয়।... যখন বিপদ আমাকে
আচ্ছন্ন করতো, আমি বুঝতে পারতাম
আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা
ভোগ করছে। যখন আমার মনের
দিগন্তে দেখা দিতো চকিত
আশার ঝলকানি, আমি জানতাম তারা
সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করছে। ... একে বলতে পারেন
প্রজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিংবা
অন্য যা খুশি তাই।
কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের
ঐশী প্রেরণা; আমি যেটা জানি
তা হলো আমার মন
বলছিল বিজয় আমাদের হবেই।
এত বিপুল রক্তদান বৃথা যেতে পারে
না। রক্ত সেই অতীব
জরুরি তরল, বাঁচিয়ে রাখে
জীবনকে এবং এমনি রক্তদান
যে আদর্শের জন্য, সেই আদর্শকেও তা
বাঁচিয়ে রাখবে।’ বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার
সম্পর্কে নানা পরস্পরবিরোধী খবর
ছড়ানো হতো। বন্দি থাকাকালে
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ-
‘সেই
সময়ে আমার সেলে যাঁরাই
এসেছিলেন তাঁদেরই দেখাতো অনেক কম আস্থাবান
ও সুস্থির। আটককারীর ঔদ্ধত্য তাঁদের মধ্যে তেমন প্রকাশ পেতো
না। বরং কোনো অজানা
দুশ্চিন্তা যেন তাঁদের পীড়িত
করতো।...
...এটা
আমার কাছে বেশ তাৎপর্যময়
মনে হয়েছিল। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে কাজে লাগতে পারে
এমন কোনো বিবৃতি আমার
কাছ থেকে আদায়ের জন্য
উপর্যুপরি প্রয়াস থেকে এর সমর্থন
মিলেছিলো। আমি অনুভব করেছিলাম,
তাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমোপলব্ধির এটা একটা ইঙ্গিত।
এর ফলে আমার মধ্যে
প্রত্যয়ী মনোভাব জেগেছিল যে, আমার দেশে
তাদের দিন ভালো যাচ্ছে
না। আমি তাদের কথা
মান্য করতে অস্বীকার করি।
আমি কোনো কিছু বলতে,
লিখতে বা সই করতে
অস্বীকার করি।...’
বঙ্গবন্ধুকে
গ্রেফতার ও বন্দি অবস্থায়
করাচী নিয়ে যাবার প্রসঙ্গে
গবেষক এস. এ. করিম
উল্লেখ করেছেন- ‘করাচী পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর
বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে একটি
অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়-
যেখান থেকে লোহার শিক
দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ
প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো
বৈদ্যুতিক পাখা ছিলো না-
পরবর্তী সময়ে একটি পুরোনো
বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো-
যা মূলত ঘরের গরমকে
আরও ছড়িয়ে দেবার জন্যই। এছাড়াও আরও নানা রকমের
অত্যাচার ছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু
এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন
বাংলাদেশের জন্য- যে বাংলাদেশটি তখন
জন্ম নেবার জন্যে লড়ছে।’
এই যন্ত্রণাদায়ক বন্দিজীবন থেকে ১৯৭২ সালের
৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে
পৌঁছান।লল্ডন থেকে ৯ জানুয়ারি
রাতে রওনা হয়ে ১০
জানুয়ারি দুপুরে দিল্লিতে উপস্থিত হন বিকাল চারটায়
দেশে ফেরার ঠিক আগে।দিল্লি বিমানবন্দরে
স্বাধীন বাংলাদেশের এই মহানায়ককে স্বাগত
জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিমানবন্দরে এ উপলক্ষে আয়োজিত
অভ্যর্থনা সভায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য
রাখেন বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী।তিনি
সেদিন বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধী
ও ভারতের জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন
করেন। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধী হিন্দিতে দেওয়া তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে
উদ্দেশ করে বলেন- ‘তাঁর
শরীরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হলেও
তাঁর আত্মাকে কেউ বন্দি করে
রাখতে পারেনি। তাঁর প্রেরণায় বাংলাদেশের
মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশকে
স্বাধীন করেছে। তিনি প্রেরণা দিতে
এখন ভারতে আমাদের কাছে এসেছেন। এই
যুদ্ধের সময় আমরা ভারতের
পক্ষ থেকে তাদের জন্য
তিনটি কাজ করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম। এক. যে শরণার্থীরা
ভারতে আছে তারা সময়
হলে ফিরে যাবে। দুই.
আমরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করবো ও বাংলাদেশের
জনগণের পাশে দাঁড়াবো তিন.
শেখ সাহেবকে (শেখ মুজিবুর রহমান)
আমরা দ্রুত জেল থেকে মুক্তির
ব্যবস্থা করবো। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি
রেখেছি।’
এরপর
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে
শুরু করলে উপস্থিত হাজার
হাজার ভারতীয় দর্শক একসঙ্গে সমস্বরে চিৎকার করে তাঁকে বাংলায়
ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। তাদের
দাবির মুখে খানিকটা বিব্রত
হয়ে পাশে দাঁড়ানো ভারতের
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে তিনিও
স্মিত হেসে বলেন, ‘দে
নিড বেঙ্গলি’। তিনি বঙ্গবন্ধুকে
বাংলায় বক্তৃতা করার আহ্বান জানান।বঙ্গবন্ধু
তাঁর দরাজ কণ্ঠে বাংলায়
বক্তৃতা শুরু করেন। ‘ভাই
ও বোনেরা’ বলতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে ভারতের
অভ্যর্থনা সভার জনস্রোত। এই
ভাষণে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান
ভারতের সকল সহায়তার জন্য।একইদিন
ঢাকার ভাষণেও তা পুনরায় উচ্চারিত
হয়।দিল্লিতে তিনি বলেন-
‘আপনাদের
প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও
সহানুভূতি আমার দুখী মানুষকে
দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে
না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের
অন্ধকার সেলের (কারাকক্ষ) মধ্যে বন্দি ছিলাম কিছুদিন আগেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার
এমন জায়গা নাই যেখানে তিনি
চেষ্টা করেন নাই আমাকে
রক্ষা করার জন্য। আমি
ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমার সাড়ে সাত কোটি
মানুষ তার কাছে এবং
তার সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার
জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর
যেভাবে এক কোটি লোকের
খাওয়ার বন্দোবস্ত এবং থাকার বন্দোবস্ত
আপনারা করেছেন...আমি জানি ভারতবর্ষের
মানুষ খুব দুখী আছে
সেখানে, তারাও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরও
অভাব অভিযোগ আছে—তা থাকতেও
তারা সর্বস্ব দিয়েছে আমার লোকরে সাহায্য
করার জন্য, চিরদিন আমরা তা ভুলতে
পারবো না।...আপনারা জানেন বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে,
আমি সকল প্রকার সাহায্য
সহানুভূতি আশা করি এবং
এও আশা করি দুনিয়ার
শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে
তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে
সাহায্য করার জন্য।...আমি
বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি
বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি
বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে।...আমাকে
প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতি
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শে এত মিল কেন?
আমি বলি, এটা আদর্শের
মিল, এটা নীতির মিল,
এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্ব
শান্তির মিল।...’
বঙ্গবন্ধু
এই ভাষণে তাঁর ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র
পরিচালনার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় তুলে ধরেন। পরে
যা বাংলাদেশের সংবিধানেও সংযুক্ত করা হয়। তার
মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম।
অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতিতেও যুক্ত হয় সবার সঙ্গে
বন্ধুত্বের নীতি।উপরন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তিও করেন তিনি।
১৯৭২
সালের ১০ জানুয়ারিতে ঢাকার
মাটি স্পর্শ করার পর উপস্থিত
জনতার ঢল দেখে নিজের
অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু।
বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জাতিকে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ
দেন, ক্লান্ত কণ্ঠে তিনি জানান-‘আমি
আজ বক্তৃতা করতে পারবো না।’
কিন্তু জানিয়েছেন- ‘আজ আমি যখন
এখানে নামছি আমি আমার চোখের
পানি ধরে রাখতে পারি
নাই।
যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি,
যে মানুষ কে আমি এত
ভালোবাসি, যে জাত কে
আমি এত ভালোবাসি, আমি
জানতাম না সে বাংলায়
আমি যেতে পারবো কিনা।
আজ আমি বাংলায় ফিরে
এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ
আজ স্বাধীন।’
তিনি
এই ঐতিহাসিক ভাষণে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাঁদের
প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে মুক্ত
মানুষের দিকে চেয়ে বলেন-
‘আমি আজ বাংলার মানুষ
কে দেখলাম, বাংলার মাটি কে দেখলাম,
বাংলার আকাশ কে দেখলাম
বাংলার আবহাওয়া কে অনুভব করলাম।
বাংলাকে আমি সালাম জানাই
আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি
বোধহয় তার জন্যই আমায়
ডেকে নিয়ে এসেছে। আমি
আশা করি দুনিয়ার সব
রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন
আমার রাস্তা নাই আমার ঘাট
নাই আমার খাবার নাই
আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা,আমার মানুষ পথের
ভিখারী। তোমরা আমার মানুষ কে
সাহায্য করো মানবতার খাতিরে
তোমাদের কাছে আমি সাহায্য
চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্র এর
কাছে আমি সাহায্য চাই।
তোমরা আমার বাংলাদেশকে তোমরা
রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ
দাও দিতে হবে, উপায়
নাই দিতে হবে। আমি
আমরা হার মানবো না
আমরা হার মানতে জানি
না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘‘সাত কোটি বাঙ্গালির
হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি
করে মানুষ করো নাই।’’ কবিগুরু
আজ মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে
গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ
মানুষ। আমার বাঙালি আজ
দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি,
এত লোক জান দেয়
নাই। তাই আমি বলি
আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।… এ স্বাধীনতা
আমার পূর্ণ হবে না যদি
বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত
না পায়, এ স্বাধীনতা
আমার পূর্ণ হবে না যদি
বাংলার মা-বোনেরা কাপড়
না পায়, এ স্বাধীনতা
আমার পূর্ণ হবে না যদি
এদেশের যুবক যারা আছে
তারা চাকরি না পায়।...’
ভাষণে
মুক্ত স্বদেশে মানুষের অধিকারের কথা তিনি শুনিয়ে
দিলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন
দালালদের বিচার করার কথা, তিনি
সরকারি কর্মচারীদের সাবধান করে দিলেন, ঘুষ
গ্রহণের বিরুদ্ধে বললেন, তিনি আমেরিকার জনসাধারণকে
ধন্যবাদ জানালেন এবং বারবার স্মরণ
করলেন ১ কোটি উদ্বাস্তু
মানুষকে ভারতের আশ্রয় দেওয়ার কথা।রক্ত আর যন্ত্রণার সিঁড়ে
বেয়ে যে স্বাধীনতা এসেছে
তা যে ষড়যন্ত্র মুক্ত
নয় তাও স্মরণ করিয়ে
দিয়েছিলেন সেদিন।অন্যদিকে নিজের আত্মপরিচয়, দেশপ্রেম আর নিজের বাঙালিত্বকে
দেশবাসীর কাছে পুনরায় স্পষ্ট
করলেন পাকিস্তানের কারাগারের স্মৃতিচারণ করার সময়-‘আমায়
আপনারা পেয়েছেন আমি আসছি। জানতাম
না আমার ফাঁসির হুকুম
হয়ে গেছে আমার সেলের
পাশে আমার জন্য কবর
খোড়া হয়েছিলো। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম,
বলেছিলাম আমি বাঙালি আমি
মানুষ, আমি মুসলমান একবার
মরে ২ বার মরে
না। আমি বলেছিলাম আমার
মৃত্যু আসে যদি আমি
হাসতে হাসতে যাবো আমার বাঙালি
জাত কে অপমান করে
যাবো না তোমাদের কাছে
ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার
সময় বলে যাবো জয়
বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা
আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।…আমি কারাগারে ছিলাম
৯ মাস আমাকে কাগজ
দেয়া হয় নাই। এ
কথা সত্য আসার সময়
ভুট্টো আমায় বললেন শেখ
সাব দেখেন ২ অংশের কোন
একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি
আমি বললাম আমি বলতে পারি
না আমি বলতে পারবো
না আমি কোথায় আছি
বলতে পারি না আমি
বাংলায় গিয়ে বলবো। আজ
বলছি ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো বাঁধন
ছিঁড়ে গেছে আর না।
তুমি যদি কোন বিশেষ
শক্তির সাথে গোপন করে
আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও
মনে রেখ দলের নেতৃত্ব
দিবে শেখ মুজিবুর রহমান
মরে যাব স্বাধীনতা হারাতে
দিবো না।’
১০ জানুয়ারির ভাষণেই তিনি দেশগঠনের আহ্বান
জানান জনগণকে।মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদাররা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল
তাতে পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। এজন্য সকলকে নিয়ে দেশগঠনের প্রত্যাশা
ব্যক্ত করেন তিনি।একতাবদ্ধ থাকতে
বলেন সকলকে। ‘স্বাধীন যখন হয়েছি স্বাধীন
থাকবো আজীবন’- এই প্রত্যয়ও ঘোষণা
করেন তিনি।১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা যেমন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণতাপ্রাপ্তি তেমনি দেশের মুক্ত মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার
স্বপ্ন বুননেরও দিন।এজন্যই তিনি বলেছেন-‘নতুন
করে গড়ে উঠবে এই
বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে বাংলার মানুষ খেলবে বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে
বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত
খাবে এই আমার সাধনা
এই আমার জীবনের কাম্য
আমি যেন এই কথা
চিন্তা করেই মরতে পারি
এই আশীর্বাদ এই দোয়া আপনার
আমাকে করবেন।’
বঙ্গবন্ধু
স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে জনগণকে উদ্দেশ্য
করে ১০ জানুয়ারি যে
বক্তব্য দিয়ে গেছেন তাতে
পরিষ্কারভাবে দেশ পরিচালনার নির্দেশনা
ছিল। কিন্তু তিনি যে ষড়যন্ত্রের
কথা সেদিন বলেছিলেন তাও সত্য হয়েছিল।১৯৭৫
সালের ১৫ আগস্ট সেই
ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয় এবং
দেশের স্বাধীনতা অপহৃত হয়ে চলে যায়
পাকিস্তানবাদী রাজনীতির কাছে।এভাবেই বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ও নির্ভীক নেতার
আসনে থেকেও নির্মমতার শিকার হয়েছেন।কিন্তু তিনি ইতিহাসে অমর
এক দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বিজয়ী বীরের
মতো ভালোবাসা নিয়ে স্বদেশে ফিরে
এসেছিলেন। তাঁর চলার পথ
ছিল জনগণের আশীর্বাদে স্নিগ্ধ। কিন্তু তিনি তাঁর স্বপ্ন
সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। ছয় বছরের নির্বাসিত
জীবন ছেড়ে তিনিও ১৯৮১
সালের ১৭ মে ভারত
থেকে দেশে ফিরে হাল
ধরেন গণতন্ত্রের।বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন আর শেখ হাসিনার
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ আজ
বিশ্বজুড়ে অভিনন্দিত রাষ্ট্র।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭