ইনসাইড ইকোনমি

অর্থ পাচার: ফিরিয়ে আনা কতটা কঠিন, কতটা সহজ?


প্রকাশ: 16/01/2023


Thumbnail

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলা বাতিলের দুই আবেদন খারিজ করেছেন নিউইয়র্কের আদালত। নিউইয়র্কের আদালতের এ রায়ের ফলে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির মামলার অভিযুক্ত ফিলিপাইনের আরসিবিসি, কিম অংসহ ১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা চলার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

অন্যদিকে গতকাল রোববার (১৫ জানুয়ারি) ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘বিদেশের একটি ব্যাংকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ৫০০ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ওই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের যে ভল্টে তাঁরা টাকা রেখেছেন, তারেক ও মামুনের ‘আই কন্ট্যাক্ট’ ছাড়া সেই ভল্ট থেকে টাকা বের করা সম্ভব নয়। যে কারণে টাকাটা এখনো ফেরত আনা যাচ্ছে না।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা এতটা সহজ হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলা নিউইয়র্কের আদালতে চলমান থাকলে, হয়তো রিজার্ভ চুরির টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে। কিন্তু মামলা একটি চলমান প্রক্রিয়া, এর  রায় পাওয়াটাও অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া, বিদেশি ব্যাংকের যে ভল্টগুলোতে পাচার করা অর্থ জমা রাখা হয়েছে, সেগুলো জমাকৃত ব্যক্তি ছাড়া হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। কেননা বিদেশের ব্যাংকগুলো, বিশেষ করে সুইজারল্যাণ্ডের সুইজ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী। সেখানের ভোল্টগুলোতে যে অর্থ, সোনা বা যে সমস্ত দামি বস্তু রাখা হয়, তা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জমাকৃত ব্যক্তির ফিঙ্গার প্রিন্ট, আই প্রিন্ট, ফেইস রিডিং ইত্যাদি ইত্যাদি পন্থায় সিকিউরিটি লক করা হয়। সেক্ষেত্রে জমাকৃত ব্যক্তি ছাড়া সেই ভল্ট খোলা সম্ভব হয়ে ওঠে না।  


জানা গেছে, সুইস ব্যাংক ব্যবস্থায় গোপনীয়তার ইতিহাস ৩০০ বছরের পুরোনো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কর ফাঁকি দিতে ইউরোপের দেশগুলো থেকে ধনীরা সুইস ব্যাংকে ভিড় বাড়ায়। অ্যাডলফ হিটলারও সুইস ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন। সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখলে সুদ পাওয়া যায় না, বরং তার জন্য বাড়তি খরচও রয়েছে।  ১৭১৩ সালে দ্য গ্র্যান্ড কাউন্সিল অব জেনেভা প্রথম ব্যাংক গোপনীয়তার আইন প্রণয়ন করেছিল। সুইজারল্যান্ড সীমান্তের এক পাশের দেশ ফ্রান্সের ব্যাংকগুলো ছিল মূলত খ্রিষ্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্টদের দখলে। ফলে ক্যাথলিকরা সুইস ব্যাংকগুলোতেই অর্থ রাখত। এমনকি ফ্রান্সের সে সময়ের ক্যাথলিক রাজাও সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখতেন। ১৭৮০ সালের দিকে সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ বিমার আওতায় আনা হয়। এতে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা আরও বাড়ে। ১৮১৫ সালে সুইজারল্যান্ড একটি নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা পেলে সুইস ব্যাংকে অর্থপ্রবাহ আরও অনেক বেড়ে যায়।

সূত্র জানায়, শুধুমাত্র সুইজ ব্যাংকই নয়। বিশ্বে এমন আরও অনেক ব্যাংক রয়েছে, যে সব ব্যাংকগুলোতে জমাকৃত অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে গোপনীয়তার নীতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ বিশ্বের এমন আরও কিছু ব্যাংকে জমা করেছেন অর্থ পাচাকারীরা। যার সুনির্দিষ্ট তথ্য হয়তো বাংলাদেশ সরকার বা কারও কাছেই নেই। কারণ এসব অর্থ পাচারের মূল মাধ্যম হলো হুন্ডি। তাই এসব অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়তো কোন দিনও সম্ভব হবে না।              


সূত্র আরও জানায়, নিউইয়র্কের সুপ্রিম কোর্ট বা স্টেট কোর্ট, ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন বা আরসিবিসি ও ছয় আসামির করা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা বাতিলের আবেদন গত শনিবার (১৩ জানুয়ারি) খারিজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি এ মামলার অভিযুক্ত অপর আসামি কিম অংয়ের মামলা বাতিলের আবেদনও খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। নিউইয়র্কের আদালতের নির্দেশনায় অভিযুক্তদের আগামী ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে মধ্যস্থতার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিউইয়র্ক আদালতের এ ধরনের নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক তথা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি পজিটিভ সাইন। যেহেতু ঘটনার সত্যতা রয়েছে, সেহেতু নিউইয়র্ক আদালত হয়তো বাংলাদেশের দায়ের করা মামলার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন। এ ক্ষেত্রে হয়তো বাংলাদেশ সফলতার হাতছানি পেতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যেমন সরকারের বিভিন্ন আমলা থেকে শুরু করে, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীরা, এমনকি সরকার বিরোধী অপশক্তিও- ব্যক্তি পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন নামি-দামি ব্যাংকগুলোতে যে সব পাচারকৃত অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রেখেছেন, তা ওইসব ব্যাংক থেকে বের করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সরকারে কাছে পাচারকৃত অর্থের পরিমান এবং পাচারকৃত ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে যে সকল দেশে অর্থ পাচার হয়েছে এবং যে সমস্ত ব্যক্তি এই অর্থ পাচারের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন, সে সব দেশের আইন অনুযায়ী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হলে- পাচার করা অর্থ হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ ছাড়াও, যে সমস্ত ব্যাংকগুলোতে ডিজিটাল সিকিউরিটি পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পাচারকৃত অর্থ রাখা হয়েছে। সে সব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেই সব দেশের আইন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে, তাদের মাধ্যমেই এসব ভল্ট থেকে টাকা বের করে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। 

বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা কতটা কঠিন, কতটা সহজ?- এমন প্রশ্নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক আমেরিকার আদালত থেকে একটা পজিটিভ সাইন পেয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকান সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডোনাল্ড লু- এর সফরের ফলে বাংলাদেশ-আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে, সেহেতু আমেরিকায় পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে। ঠিক একইভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশুগলোতে এই ধরনের তৎপরতা চালানো হলে ফলাফল একেবারে শূণ্যের অঙ্কে থাকবে না।

তাঁরা বলছেন, এ ধরনের যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ায় ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ঠ। কারণ প্রবাদে একটি কথা রয়েছে, ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়’, ইংরেজিতে ‘হোয়ার দেয়ার ইজ অ্যা উইল, দেয়ার ইজ অ্যা ওয়ে’- এই কথাটি একবারে মিথ্যে নয়। সরকার কাকে ধরবে আর কাকে ছাড় দিবে, সেটি একান্তই সরকারে বিষয়, রাষ্ট্রের বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিলে, ফলাফল শূণ্য হবে না। এখন দেখার বিষয় পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭