ইনসাইড পলিটিক্স

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ: কী ভাবছে রাশিয়া?


প্রকাশ: 23/01/2023


Thumbnail

চলতি মাসেই বাংলাদেশে এসেছিলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ভূরাজনৈতিক গতিশীলতার দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত ১৪ জানুয়ারি দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় তাকে নিয়ে যে নেতিবাচক ভাবমর্যাদা তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশেও একই ধরনের ‘জবরদস্তিমূলক’ কূটনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন বলে গণমাধ্যমে নানা জল্পনা-কল্পনা ছিল। তবে তার সফরের বিভিন্ন দিক বিবেচনায়, কূটনৈতিক মহল এটি অত্যন্ত সফল সফর হিসেবে গণ্য করেছে। 

এদিকে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা ‘উরসা মেজর’ নামের একটি জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল রাশিয়া। গত ২৪ ডিসেম্বর ‘উরসা মেজর’ নামে রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজটির রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। তার আগেই ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়, জাহাজটি আসলে ‘উরসা মেজর’ নয়- এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজ। পরে জানতে পেরে জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে বাংলাদেশ। যদিও জাহাজটিকে বন্দরে পণ্য খালাসের অনুমতি দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাশিয়া। তবে জাহাজটি বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার বিষয়ে অনড় ছিল বাংলাদেশ।


কূটনেতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতির ফলেই হয়তো এমনটি করতে পারে রাশিয়া। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশকে নিয়ে রাশিয়ার কী ভাবনা?- তা একমাত্র রাশিয়াই জানে। তবে কেন জেনেশুনে এমন কাজটি রাশিয়া করেছে- তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কোন দেশের সাথে কি ধরনের সম্পর্ক বাংলাদেশের থাকবে, সেটা নির্ভর করছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ওপর। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে, ‘সবার সাথেই বন্ধুত্ব, কারো সাথেই বৈরিতা নয়’- সেই পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।            

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর দুই দেশের ঐতিহ্যগত বন্ধন দৃঢ় করার পাশাপাশি সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে একে অপরকে বোঝার ও উভয়পক্ষের ভুল ধারণাগুলো দূর করার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের র‌্যাবের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নিষেধাজ্ঞা ছিল। সে নিষেধাজ্ঞা আবারও হতে পারে- এমন সন্দেহ নিয়েও ছিল নানান অভিমত। কিন্তু ডোনাল্ড লু’র সফরে নিশ্চিত হয়, বাংলাদেশের ওপর আর নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে না বিশ্বের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র।


কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডোনাল্ড লু’র সফরের পরপরই আইএমএফ থেকে বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি চূড়ান্ত করতে ঢাকায় আসেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। এ চুক্তিটিও সম্পন্ন করেন আইএমএফ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। এর পরই শনিবার (২১ জানুয়ারি)  ঢাকায় আসেন বিশ্বব্যাংক এমডি  অ্যাক্সেল ভন ট্রটসেনবার্গ। তিনি এসেই বাংলাদেশকে একটি উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের অভীষ্টে পৌঁছাতে বিশ্বব্যাংক পাশে থাকবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানও সংস্থাটির পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়। সব মিলিয়ে আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে টানাপোড়েন চলছিল, তা আরও পাকাপোক্ত এবং শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।       

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা ‘উরসা মেজর’ নামের একটি জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল রাশিয়া। গত ২৪ ডিসেম্বর উরসা মেজর নামে রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজটির রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। পরে বাংলাদেশ জানতে পারে যে, এই জাহাজটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজ। যেটির রঙ ও নাম বদল করে ‘উরসা মেজর’ নাম দেওয়া হয়েছে। জাহাজটির আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার (আইএমও) সনদ নম্বর: ৯৫৩৮৮৯২, যা প্রকৃতপক্ষে ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজের সনদ নম্বর।  



পরে বিষয়টি যাচাই করে বাংলাদেশ নিশ্চিত হয়ে জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে দেয়। পরে জাহাজটি পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরে গিয়ে সরঞ্জাম খালাসের চেষ্টা করে। কিন্তু সরঞ্জাম খালাসের জন্য জাহাজটি নয়াদিল্লির অনুমতি পেতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় ১৬ জানুয়ারি ভারতের জলসীমা ছেড়ে যায় জাহাজটি। বর্তমানে জাহাজটি চীনের একটি বন্দরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হচ্ছে। 

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ভারতের বন্দরে ভিড়তে না পারায় জাহাজটিকে রুট পরিবর্তন করিয়ে চীনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চীনের সায়েনথো বন্দরে গিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য খালাস করতে চায় রাশিয়া। আশা করা হচ্ছে, আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে জাহাজটি চীনের বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে।

গ্লোবাল শিপ ট্র্যাকিং ইন্টেলিজেন্সের তথ্য বলছে, ‘উরসা মেজর’ জাহাজটি চীনের সায়েনথোর দিকে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে আট দিনের মাথায় জাহাজটি সায়েনথো বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে।   

এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন রবিবার (২২ জানুয়ারি) গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের কাছে তাজ্জব লেগেছে যে রাশিয়া জেনেশুনে নিষেধাজ্ঞা আছে- এমন জাহাজের নাম পরিবর্তন করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পণ্য পাঠিয়েছে। আমরা এটি আশা করিনি। আমরা আশা করি, রাশিয়া এখন নিষেধাজ্ঞা নেই এমন একটি জাহাজে পণ্যগুলো পাঠাবে। রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে। এর বাইরে তাদের কয়েক হাজার জাহাজ আছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা রাশিয়াকে বলেছি, তাদের যেসব জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, সেগুলো ছাড়া অন্য যেকোনো জাহাজে পাঠাতে পারে। নিষেধাজ্ঞা আছে, এমন জাহাজ আমরা গ্রহণ করতে চাই না।’

এসব বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হয়তো এমনও হতে পারে, রাশিয়া ভুল করেই নাম এবং রঙ পরিবর্তন করা জাহাজটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পণ্য খালাসের জন্য পাঠিয়েছিল। অথবা এমনও হতে পারে, রাশিয়া ভাবতেই পারেনি নাম এবং রঙ পরিবর্তন করা হলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা জাহাজটিকে চিহ্নিত করতে পারবে আমেরিকা। এখন দেখার বিষয় রাশিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে কী ভাবছে? কেনই বা ‘উরসা মেজর’ নাম দিয়ে ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজটিকে বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পণ্য  খালাসের জন্য পাঠিয়েছে?


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭