ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

আর্থিক ঝড়ের কবলে বিশ্বের অন্যতম ধনী গৌতম আদানির সাম্রাজ্য


প্রকাশ: 28/01/2023


Thumbnail

ফোর্বসের ধনীদের তালিকায় তিন নম্বর থেকে সাতে নেমে গেছেন ভারতের গৌতম আদানি। আদানির শুধু সম্পদই কমেনি, তাঁর ব্যবসার ধরন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, খ্যাতি বলতে যা ছিল, তাতেও বড় ধাক্কা লেগেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ঘনিষ্ঠতাই আদানির সাফল্যের রহস্য বলেও বিরোধীরা এতোদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্স এবং নিউইয়র্ক টাইমস। 

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ভারতের গৌতম আদানি স্কুল থেকে ঝরে পড়া এক বিলিয়নিয়ার; যিনি হয়ে উঠেছিলেন এশিয়ার শীর্ষ ধনী। সম্ভবত এ সময়ে তিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের শেয়ারে কারসাজি, কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি আর আর্থিক লেনদেনে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর এক প্রতিবেদন প্রকাশের পর টালমাটাল হয়ে উঠেছে আদানির সাম্রাজ্য। গত এক সপ্তাহে তাঁর সম্পদমূল্য কমেছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার।

নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, পশ্চিম ভারতের গুজরাটে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন গৌতম আদানি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একই রাজ্য থেকে রাজনীতিতে উঠে আসেন। বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, আদানি ও মোদির মধ্যে বহু বছর ধরে ব্যবসা ও রাজনীতি নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ব্যবসায়িক সুবিধা পেয়েছেন আদানি- এমন অভিযোগ, বিরোধীরা তুললেও তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন আদানি।

২০১৪ সালে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আদানি বলেছিলেন, রাজনীতির সব পক্ষের সঙ্গেই তাঁর ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তবে তিনি নিজে রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। মোদি সরকারও আদানিকে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। মোদি আদানির করপোরেট বিমান ব্যবহার করার পর এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। তবে আদানি জানিয়েছিলেন যে, ‘মোদি পুরো টাকা পরিশাধ করেন’।

মার্কিন অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, তিনদিন আগেও বিশ্বের শীর্ষ তৃতীয় ধনী গৌতম আদানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে ২২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার হারিয়ে শীর্ষ ধনীর তালিকায় সপ্তম স্থানে নেমে গেছেন তিনি।

স্বল্প সময়েই আদানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে তাঁর সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। শুরু থেকেই একটি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্য ছিল আদানির। এ জন্য সমুদ্র বন্দর ও বিমান বন্দর থেকে শুরু করে একে একে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, খনি, ভোজ্যতেল, পুননবায়নযোগ্য জ্বালানি ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করেন তিনি। সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সিমেন্ট খাতেও বিনিয়োগ করেছেন ভারতের সবচেয়ে ধনী এই ব্যক্তি। আদানির ব্যবসা সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাতটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দামও হু হু করে বেড়ে যায়। বিশেষ করে সর্বশেষ তিন বছরে তাঁর কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম দেড় হাজার শতাংশেরও বেশি বেড়েছিল বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। এ সময়ে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগও পেয়েছেন আদানি।

এ সময় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি বনে যান আদানি। তার আগে ছিলেন বার্নার্ড আরনল্ট এবং ইলন মাস্ক। এ সময় তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৭ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় (প্রতি ডলার ১০০ টাকা ধরে) ১২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও একটা সময় পর্যন্ত ৬০ বছর বয়সী আদানি অন্যান্য শত কোটিপতিদের তুলনায় অনেক কম পরিচিত ছিলেন। আদানি নিজেই সক্রিয়ভাবে তাঁর সব কটি শাখার ব্যবসা পরিচালনা করেন। নিজের দুই ছেলে করণ ও জিৎকে এখন তিনি ব্যবসায় যুক্ত করেছেন। তাঁর স্ত্রী প্রীতি আদানি দাঁতের চিকিৎসক।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, সম্প্রতি আদানি তাঁর ভাবমূর্তি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এ জন্য তিনি দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। ভারতের অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম এনডিটিভির বড় অংশের শেয়ার কিনে নেওয়াও তার এমন কার্যক্রমের একটি অংশ বলে মনে করা হচ্ছে বলেও জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

গত কয়েক বছর আদানি গোষ্ঠী ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম সবুজ হাইড্রোজেন ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার জন্য গত বছর আদানির সাথে চুক্তি করেছে ফ্রান্সের টোটাল এনার্জিস। অতি সম্প্রতি আদানি তার ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় থাকার পন্থা বেছে নিয়ে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

চলতি মাসে ভারতের জনপ্রিয় একটি হিন্দি টেলিভিশনের ‘পিপলস কোর্ট’ নামে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। এ সময় তিনি আদালতের আদলে বানানো ‘কোর্টরুমে’র ভেতরে বসেন এবং তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জবাবও দেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে তিনি নিজেকে ‘একজন লাজুক ব্যক্তি’ হিসাবে বর্ণনা করেন এবং ‘রাজনৈতিক আক্রমণের’ মুখোমুখি হওয়াকেই তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ বলে জানান।

নিজেকে একজন লাজুক ব্যক্তি হিসেবে দাবি করা আদানি বলেছেন, তার জনপ্রিয়তার অন্যতম কৃতিত্ব বিরোধীদের। কারণ, তাঁদের ক্রমাগত সমালোচনার কারণেই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। ‘মানুষজন আদানিকে চিনতে পেরেছে রাহুলজির জন্য; কারণ, তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং এরপর থেকে তাঁকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আসছেন।’- এ মাসের আরও আগের দিকে এক অনুষ্ঠানে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্পর্কে বলেছিলেন আদানি। অনুষ্ঠানে দেশটির বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর কথা উল্লেখ করে আদানি বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় এবং এর পরে রাহুল গান্ধী তাকে ক্রমাগত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কারণে মানুষ আদানিকে জানতে পেরেছে।’

অনুষ্ঠানটির তিন সপ্তাহের মাথায় শুক্রবারে আদানির কোম্পানির শেয়ারে ধস নামে। শুধু চলতি সপ্তাহেই তাঁর কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের মূলধন হারিয়েছে। 

হিনডেনবার্গ রিসার্চ বলছে, আদানির ব্যবসাগুলো বিশ্বের নানা জায়গায় দেয়া কর অবকাশ সুবিধার অনুচিত ব্যবহার করেছেন। একই সঙ্গে আদানির বিপুল ঋণের বিষয়েও যে উদ্বেগ রয়েছে, তা-ও তুলে ধরেছে ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, আদানির জন্য বিতর্ক অবশ্য নতুন কিছু নয়। কেরালায় তাঁর ৯০ কোাটি ডলারের বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে মৎস্যজীবীদের বিক্ষোভ হয়েছে, যার জন্য তিনি রাজ্য সরকার ও জেলে সম্প্রদায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর কারমাইকেল কয়লা খনির বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।

এ সম্পর্কে ভারতের ইমেজ গুরু হিসেবে পরিচিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পারফেক্ট রিলেশনসের সহপ্রতিষ্ঠাতা দিলীপ চেরিয়ান রয়টার্সকে বলেন, হিনডেনবার্গ রিপোর্টের প্রতিবেদন আদানির খ্যাতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে আদানি সেই ক্ষতি সীমিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে এবং বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে আশ্বস্ত করতে পারেন। তবে যে ধরনের উল্কাগতিতে আদানির উত্থান হয়েছে, তাতে তিনি যে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছেন, সে ব্যাপারে হয়তো খুব কম মানুষই দ্বিমত করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এক গবেষণা প্রতিবেদনে আদানি অফশোর ট্যাক্স হেভেন ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ করে। তবে আদানি এই প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন।

এদিকে আদানি গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের রুপকল্প হল ‘ভালোর সাথে প্রবৃদ্ধির’ ভারসাম্য। কারণ জাতীয় প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে সম্পদ তৈরি, আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্থায়িত্বের মাধ্যমে জনজীবনে রূপান্তর ঘটানো তাদের লক্ষ্য।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭