ইনসাইড আর্টিকেল

আগুনঝড়া ফেব্রুয়ারি শুরু, প্রতিরোধ ও জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষকাল


প্রকাশ: 01/02/2023


Thumbnail

আজ ১লা ফ্রেব্রুয়ারি, শুরু হলো ভাষার মাস। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী ঢাকার রাজপথ ছিল উত্তাল। ঢাকার রাজপথে সেদিন যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের অমলিন স্মৃতি স্মরণের মাস এই ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির কাছে এই মাস ভাষার মাস, এই মাস দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার মাস, এই মাস মায়ের মুখের ভাষা ছিনিয়ে আনার মাস। যে কারণেই বাঙালি জাতি নানা আয়োজনে পুরো ফ্রেব্রুয়ারি মাসজুড়েই ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানায় মহান ভাষা শহীদদের প্রতি।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’- আজ থেকে শুরু হলো রক্তে রাঙানো সেই ভাষা আন্দোলনের মাস। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষকাল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির সেই আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। 

ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে যেমন শোকের মাস, অন্যদিকে তেমনি গৌরবোজ্জ্বল মাস। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি একমাত্র জাতি, যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এর মধ্যদিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে নানা কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবার হয়ে উঠবে জমজমাট।

অন্যদিকে মহান একুশের এ মাসের সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ মাসব্যাপী বইমেলাও শুরু হচ্ছে আজ।

আদি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক জীবন এবং ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে বাঙালির শৌর্য-বীর্য যেন ধপ করে জ্বলে উঠে এ মাসেই। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফাগুনের আগুনঝড়া দিনগুলোতে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত একাকার হয়ে যায়। ভাষার জন্য প্রথম বলীদান বিশ্ববাসীর কাছে অবাক বিস্ময় হয়ে ওঠে। সেই থেকে শুরু হয়ে যায় বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে হিসেব-নিকেশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাঙালি শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। পলাশীর আম্রকাননে হারিয়ে যাওয়া সেই সিরাজদ্দৌলা আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপে এ লড়াইয়ে সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হন।

১৯৫২ সালে যে আগুন রাজধানী ঢাকার বুকে জ্বলে উঠেছিল, তা ক্রমান্বয়ে শহর থেকে গ্রাম, সে আগুন যেন ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের আনাচে-কানাচে, গ্রামে-গঞ্জে সবখানে। প্রাণে প্রাণে ধ্বনিত হতে থাকে, যে আগুন জ্বলেছিল মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে- সবখানে- সবখানে। বাঙালির বুকের ভেতর জ্বলে ওঠা আগুন যেন সহস্র- লক্ষ-কোটি বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে বিদ্যুৎগতির মতো, যেন ত্বরিৎ প্রবাহ শুরু হয় বাঙালির শিরা-উপশিরা আর ধমনীতে। যার প্রবাহ এসে শেষ হয় ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম নতুন এক বাংলাদেশ।

বায়ান্নর আগুনঝরা সে দিনগুলো বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে এবং অমলিন হয়ে রবে সেই ভাষা শহীদদের স্মৃতি। কি এক তেজোদ্দীপ্ত  প্রেরণা, ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিল বাঙালি ছাত্র-জনতা! প্রতি বছরের মতো আবারও এসেছে ভাষার মাস। ভাষা শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি এই দেশের মানুষের চেতনায় এক অনির্বাণ বাতিঘর। এই আলোর স্পর্শে অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার এবং প্রবল দেশাত্মবোধের অন্যরকম এক আবেগ ও উদ্দীপনায় জেগে ওঠেছিল সর্বস্তরের মানুষ।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি:

পাকিস্তানের জন্মের সাত মাস পরে, ১৯৪৮ সালের মার্চে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন তার জীবনের প্রথম ও শেষবারের মত পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন- তিনি হয়তো ভাবেন নি যে, সেখানে তার উচ্চারিত কিছু কথা এক সময় তারই প্রতিষ্ঠিত নুতন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভুমিকা রাখবে। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগেরও সভাপতি ছিলেন।

নয় দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকায় প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে- যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে পরিচিত। এই বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু - অন্য কোন ভাষা নয়।

ইংরেজিতে দেয়া সেই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।”

কয়েকদিন পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে আরো একটি ভাষণ দেন। সেখানেও একই কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোন ভাষা ব্যবহার করতে পারে- তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। ইংরেজিতে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘উর্দু এণ্ড উর্দু সেল বি স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান।’ 

এই কথাটি বলার সাথে সাথেই কার্জন হলের কয়েকজন ছাত্র 'না' 'না' বলে চিৎকার করে সে সময় প্রতিবাদ করেছিলেন। ফলে এ সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর তিনি আবারও বক্তব্য শুরু করেছিলেন।

জিন্নাহ ঢাকায় এসব কথা বলেছিলেন বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে। তার ঢাকা সফরের আগেই পূর্ববঙ্গে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেখা যায়, নতুন দেশের ডাকটিকিট, মুদ্রা, মানি-অর্ডার বা টাকা পাঠানোর ফর্ম, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড- এগুলোতে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ সমাবেশও করেছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত উর্দুভাষী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রতি বিরূপ আচরণের অভিযোগ ওঠে। একই রকম মনোভাবের শিকার হন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তারাও। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সরকারি চাকরিতেও ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য। পরে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নৌবাহিনীতে লোক নিয়োগের ভর্তি পরীক্ষাও হচ্ছে উর্দু ও ইংরেজিতে। সে সময় এ নিয়ে আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিল।

জিন্নাহ যেদিন কার্জন হলে ভাষণ দেন- সেদিনই বিকেলে তার সাথে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল । এ সময় ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক প্রায় ঝগড়াঝাটির স্তরে পৌঁছে যায়। এ সময় জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপিও দেয় ছাত্রদের দলটি। তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয় এবং কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের মত একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এমন কিছু দেশের উদাহরণ দেয়া হয়। এই ছাত্র নেতারা অনেকেই ছিলেন জিন্নাহর দল মুসলিম লীগের। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বঙ্গের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের চাইতে ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছিল।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭