প্রকাশ: 02/02/2023
দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলণ
হওয়ার কথা থাকলেও- কথা কেবল কথাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাংলা ভাষার সর্বস্তরে ব্যবহারের
বিভিন্ন রকম বুলি কেবলমাত্র আমরা এই মাসেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি এলেই শুনে থাকি।
প্রকৃতপক্ষে বাঙালির ভাষা চেতনার মাস ফ্রেব্রুয়ারি চলে গেলেই এসব আওড়ানো বুলি সময়ের
বিবর্তণে বৃহদ্রন্ত্রের গহ্বরে হারিয়ে যায় এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সেই
কথাও আমরা ভুলে যাই। ফলে বাংলা ভাষার জন্য একটি বিপদ সঙ্কেত বিরাজ করে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সকল ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের
জয়জয়কার আমরা দেখে থাকি। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য বলীদান দেওয়ার যে ইতিহাস, তা বিশ্বের
আর কোনো দেশের ইতিহাসে নেই। তথাপিও সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার, ইংরেজি মাধ্যমের
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলা ভাষার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাংলা ভাষার জন্য
বিপদ সঙ্কেত ইংরেজি মাধ্যম।
এই ফেব্রুয়ারি মাসেই সর্বক্ষেত্রে বাংলাকে প্রকৃত অর্থেই প্রচলিত করার উদ্দেশ্যে জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবি, প্রথিতযশা নেতা, আমলা, ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী- সকলের বাচনে নানামুখী অঙ্গীকার আমরা প্রত্যক্ষ রূপেই শ্রবণ করি। এসব ভাষাগত শৌর্য-বীর্যের বাংলা শব্দভাণ্ডারের কথামালা কেবল এ মাসেই- এই ফেব্রুয়ারিতেই। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্লেষণ এখন সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। যেসব পণ্ডিত ব্যক্তিরাই এ মাসে ফাঁকা বুলি আওরে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন, তারাই আবার নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য আপন সন্তানকে ভর্তি করছেন ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে। আবার বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজনের সামনে নিজের স্ট্যাটাস প্রকাশের জন্য বলছেন, ‘আমার ছেলেকে তো অক্সফোর্ডে ভর্তি করেছি।’ সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যম সূত্রে
জানা যায়, ‘বাংলা ভাষা প্রচলণ উদ্যোগ’
নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে নামফলকের উপরে ৬০ ভাগ
বাংলা ও নিচে ৪০ ভাগ অন্য যে কোনো ভাষা ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছিল। এ ধরনের বাংলা
ভাষার প্রচলণ কাসুন্দি আর কতদিন পর্যালোচনার বিষয় হবে- এটাই আজ দেশবাসীর প্রশ্ন।
এটি সর্বজনবিদিত যে, ভাষাভিত্তিক জাতি
হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে হাজার বছরের বহু আগে। ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান ভাষার
মতো বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রায় দশম শতক থেকেই ঐতিহ্যমণ্ডিত। মূলত মানব সংস্কৃতির বস্তুগত
উপাদান সৃষ্টির পটভূমিতে রয়েছে অবস্তুগত জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই ধ্যানধারণা। অবস্তুগত সংস্কৃতির
প্রধান উপকরণ হিসেবে ভাষা মানুষের মনোজগতের ভাব-কল্পনা, সাহিত্য-শিল্পকলা ইত্যাদির
অপার্থিব ঐতিহ্যের ধারক-বাহকরূপে চিহ্নিত।
যেহেতু অন্য প্রাণীর কোনো ভাষা নেই,
তাই তাদের সংস্কৃতিও নেই। একমাত্র ভাষার কারণে মানুষ সংস্কৃতিমান হতে পেরেছে, সাহিত্য
সংস্কৃতির অনুসারী হতে পেরেছে। বিজ্ঞজনের মতানুসারে, এ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা
বাংলা এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
এ উপমহাদেশে দ্বিতীয় নবজাগৃতির সূচনা করেছিল।
বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিশাল আত্মত্যাগের মহিমা শুধু বাঙালি জাতির,
তাই ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ব আজ গৌরবদীপ্ত
হয়েছে। খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতানুসারে- ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে
এর প্রকাশকালকে যদি চিহ্নিত করা হয়, তাহলে এ ভাষার সমৃদ্ধির ইতিহাস প্রায় চৌদ্দ শ’ বছরের। বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনার
উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে এ ভাষার অবদান শুধু ঐতিহ্যমণ্ডিত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে
জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ ভাষার অবদান এক অসাধারণ চেতনায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে
দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান
মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একুশের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো
তথা জাতিসত্তার সংবিধানসম্মত প্রধান চার স্তম্ভ- জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র
ও সমাজতন্ত্রকে জাতি তাদের সামগ্রিক আর্থসামাজিক- সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ
হিসেবে গ্রহণ করেছে।
মাতৃভাষা বাংলাকে প্রায়োগিক অর্থে যথাযথ
মূল্যায়ন না করে এবং সর্বত্র এর বিকাশমানতাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি
অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমাদের তৎপরতা কোনোভাবেই জাতির সামষ্টিক উন্নয়নে
ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সব স্তরে এবং সব জনপদে শিক্ষাকে যদি
কার্যকরভাবে জনপ্রিয় করা না যায়, তাহলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং এর প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন
নিয়ামকগুলোর তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বাংলা ভাষা বিপদগ্রস্ত, বাংলা ভাষার
জন্য বিপদ সঙ্কেত ইংরেজি মাধ্যম- এ রকম একটা কথা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব শোনা যাচ্ছে।
তবে ইংরেজি ভাষা বা অন্য ভাষাকে আমরা শিক্ষার আওতায় আনবো না, ঠিক তেমনটি নয়। শিক্ষার
কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বাংলাদেশ হিসেবে, প্রাধান্যতার দিক বিবেচনা থেকে বাংলা ভাষার
ব্যবহার এদেশের সকল ক্ষেত্রে হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমার সন্তান ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে
পড়াশোনা করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, কিন্তু বাংলা তার শেকড়, সেই শেকড়কেই সে ভুলে গেছে।
ভুলে গেছে গর্বিত বাঙালির ভাষা অর্জনের ইতিহাস, তবে এই বলীদানের মূল্য কি?
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য পুরোধা ব্যক্তিত্ব
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনিও বাংলা ভাষার বিপদ নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
এটি একটি অত্যন্ত পুরোনো উদাহরণ। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘বাঙালি ভদ্রলোক সন্তানরা
পরস্পর কথা বলে ইংরেজিতে, চিঠিপত্র লেখে ইংরেজিতে এবং হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন
লোকে দুর্গাপূজার আমন্ত্রণপত্রও ইংরেজিতে লিখবে।’
ঔপনিবেশিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি সে সমাজে
প্রতাপশালী ছিল। দেশীয় অভিজাতরা সে প্রতাপ কার্যত মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ইংরেজির
প্রভাব-প্রতিপত্তি আজকের দিনে বঙ্কিমের সময়ের চেয়ে সম্ভবত কম নয়। এখন ঔপনিবেশিক শাসন
না থাকলেও উপনিবেশিত মন আছে। বাইরের টানের চেয়ে মনের টান সাধারণত শক্তিশালী হয়। তবে
ভাষা প্রশ্নে সে যুগের সঙ্গে আমাদের- এ কালের পার্থক্যও আছে। বঙ্কিমচন্দ্ররা বাংলায়
বিচার-সালিস করতে পারতেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতেন না। কিন্তু তাঁরা মনে করতেন,
বাংলায় এ কাজগুলো করা যায় এবং করা দরকার। আজকাল বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক মহলগুলো বিপরীত
সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁরা মনে করছেন, বাংলায় এ কাজগুলো কোনোমতে করা হয়তো যায়, কিন্তু
করাটা ভালোও নয়, লাভজনকও নয়। এই যে ধারনাটা মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ওপরের শ্রেণিগুলোতে
গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যাচ্ছে, তা-ই আসলে বাংলা ভাষার জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ
সঙ্কেত।
কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের
যে বড় অংশটা বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তাঁরা এ কথাটা
বলেন না। তাঁরা প্রধানত ভাষা-মিশ্রণের কথা বলেন, ‘উচ্চারণ-বিকৃতি’র কথা বলেন এবং বিশেষভাবে বলেন, ‘প্রমিত-বিচ্যুতি’র কথা। তাঁরা এসব ‘দুরবস্থা’কেই বাংলা ভাষার বিপদ বলে সাব্যস্ত
করেছেন। ফরাসি ভাষার অধ্যাপক ও ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্য ২০১৭ সালের দিকে
‘বাংলা ভাষা: প্রকৃত সমস্যা ও পেশাদারি সমাধান’- বইয়ে বাংলা ভাষার বিপদ সঙ্কেতের এই ব্যাপারটার পর্যালোচনা
করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ভাষা-মিশ্রণ এবং ভাষার বিবর্তন যে কোনো ভাষার খুব স্বাভাবিক
নিয়তি। যদি বিশেষ শ্রেণি-পেশার স্বেচ্ছাকৃত-আরোপিত বিকৃতি সমস্যার কারণ হয়ও, তা খুবই
গৌণ, মুখ্য নয়। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের একটা গৌণ ব্যাপারকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত
সমাজ বড় বিপদ হিসেবে দেখছে কেন?
প্রকৃতপক্ষে ভাষার বিবর্তন এখানে মুখ্য
বিষয় নয়। বাচনভঙ্গি এবং উচ্চারণগত দিক থেকে অন্যান্য ভাষার বিবর্তন হলেও বাংলা ভাষার
বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ভাষার বিবর্তনটা খুবই অপ্রাসঙ্গিক। কেননা এখানে ভাষার
ব্যবহারটা প্রাসঙ্কিক বিষয়। অঞ্চলভেদে ভাষার বিবর্তন দেখা গেলেও বাংলাকে মূলত মায়ের
মুখের ভাষা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মা যদি সন্তানকে জন্মের পর থেকে মাম্মি,
পাপা, ডেডিতে অভ্যস্থ করে তুলে বিলেতি কায়দায় বড় করে তুলতে চায়, তাহলে বাংলা ভাষা অস্তিত্ব
সঙ্কটে পড়বে এবং তাই হচ্ছে। যে কারণেই বাংলা ভাষার বিপদ সঙ্কেত ইংরেজি মাধ্যম।
বিন্দু থেকে বৃত্ত। যদি বিন্দুটাই না থাকে তবে বৃত্তটা হবে কিভাবে? ভাষার বিপদ আসলে মানুষেরই বিপদ। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা। দ্বিতীয় ভাষা রপ্ত করে কাজ চালানোর জন্য শ্রম দিতে হয়। বিপুল সময় ব্যয় করতে হয়। যে শ্রেণির পক্ষে তা করা সম্ভব, তা তারা করছে। করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে তো এ পরিমাণ সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশের ভাষানীতি বিদ্যমান শ্রেণিগত অসাম্যকে রীতিমতো জোরালো করেছে। এটা গণতন্ত্রবিরোধী এবং রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়নের অন্তরায়ও বটে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে যাঁরা সাফাই গান এবং তৎপরতা চালান, তাঁরা রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সামগ্রিক দিক থেকে ভাষাকে দেখেন না। যদি দেখতেন তবে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বিচরণ আমরা প্রত্যক্ষ করতাম। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে অক্ষুন্ন রাখতে হলে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। বাংলা ভাষার বিপদ সঙ্কেত মুছে দিতে হলে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করাসহ তা পর্যবেক্ষণের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা করা উচিত বলেই মনে করছেন বিজ্ঞজনরা।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭