ইনসাইড আর্টিকেল

ভাষা বিতর্কের উৎপত্তি এবং বাংলার ‘ভাষা আন্দোলন’


প্রকাশ: 03/02/2023


Thumbnail

ভাষা মূলত একটি মাধ্যম। যে শব্দগুলোর বিনিময়ে একে অপরকে কাছে টানে, বুঝতে পারে, জানতে পারে। এই শব্দ মাধ্যমগুলোর সমষ্টিই হচ্ছে ভাষা। সৃষ্টির আদিতে মানুষ ভাষার ব্যবহার করতে জানতো না। বিভিন্ন গোত্র, উপ-গোত্র বা সম্প্রদায় ইশারা-ইঙ্গিতে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করতো। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ ভাষার ব্যবহার করতে শিখে, এর পর শুরু হয় অক্ষর বিন্যাস অর্থাৎ লেখার চর্চা।

মূলত মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ভাষা ব্যবহারের প্রচলণ করেছিল। একেকটি অঞ্চলের একেকটি সম্প্রদায়ের ভাষা একেক রকম হয়ে থাকে। উচ্চারণগত ভিন্নতার কারণেও বাংলাদেশেই বাংলা ভাষাভাষি বিভিন্ন মানুষের ভাষাগত ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিদদের মতে, বাংলা ভাষা একটি আদি ভাষা। এর রয়েছে প্রায় ১৪শ’ বছরের ঐতিহ্য। বাংলা গদ্য সাহিত্য কিংবা  দৈনিক পত্রিকাতেও পাকিস্তান আমলে সাধু ভাষার প্রচলণ লক্ষ্য করা গেছে। এটিও  বাংলা ভাষা,  লেখ্য বা সাধু ভাষা এবং আবার এর রয়েছে কথ্য বা চলিত ভাষা। বাংলাতে এমন ভাষার ব্যবহার খুব বেশি দিন আগের নয়। দিনে দিনে পরিমার্জন, পরিশোধন এবং পরিচর্যার কারণে সমসাময়িক সময়ে বাংলা ভাষার একটি প্রমিত রূপ ধারণ করেছে বলেই মনে করছেন ভাষাবিদরা।

ভাষাবিদরা বলছেন, এর মূলে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের অবদান। বাংলা সহিত্যের কথা সাহিত্যিকেরা তাদের রচিত বিভিন্ন বইয়ে শুদ্ধ বাংলা ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়ে আজকের বাংলা ভাষার রূপ সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে বাংলা ভাষারও অন্য একটি ভিন্ন রূপ ছিল। ব্যাকরণগত দিক থেকে যাকে বলা হতো সাধু ভাষা, তবে সে সময় কথ্য বা চলিত ভাষার ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে ভাষা বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে যখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের এক অধিবেশনেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে তখন পর্যন্ত এ সমস্যাটি তত প্রকট হয়নি। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের একটি উদ্যোগ নিলে ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। তৎকালীন বাংলা সরকারের সময়ও ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের প্রাক্কালে এই বিতর্ক মৃদুভাবে দেখা দেয়।

কংগ্রেস নেতারা হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে পাল্টা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ উর্দু ভাষাকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে খুব ক্ষুদ্র হলেও বাংলার পক্ষে দাবি ওঠে। তবে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন ভাষা বিতর্ক নতুন রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মাসে  মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন।

এ সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন। পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পত্র-পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। এ সময় পূর্ববঙ্গে গঠিত বিভিন্ন সংগঠনও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ এর জুলাই মাসেই কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘গণআজাদী লীগ' নামে একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। এই সংগঠন স্পষ্টভাবে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে। পরের মাসে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা বিতর্ক আরো প্রকাশ্য রূপ লাভ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত ‘তমদ্দুন মজলিস’ সভা-সমিতি ও  লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। এই সংগঠনের উদ্যোগে ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ যার আহ্বায়ক মনোনীত হন নূরুল হক ভূঁইয়া। পরবর্তীকালে এ উদ্দেশে কয়েকটি কমিটি গঠিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিসের গঠিত প্রথম সংগ্রাম পরিষদটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভা ও স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

তবে পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি ও আশা-আকাঙ্খাকে উপেক্ষা করে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সরকারি কোন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার বাইরেও এ আন্দোলনের প্রসার ঘটে। ঢাকায় ৬ ডিসেম্বর প্রতিবাদ মিছিল শেষে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। যদিও এ পর্যায়ে সরকার যড়যন্ত্রের পাশাপশি উর্দুভাষী মোহাজেরদের বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ১২ ডিসেম্বর এমনি একটি বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষে বেশ কযেকজন বাঙালি ছাত্র আহত হন।

ভাষা সৈনিক নূরুল হক ভূঁইয়া এ ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “বাঙালিদের ওপর অবাঙালিদের এটা যে অন্যায় হামলা ছিল- তা সবার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়। বাঙালির মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব, জাতীয় সত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে ভাষা আন্দোলন দ্রুত জনসমর্থন লাভ করে।”

এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করে। সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং ১৫ দিনের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই ভাষা প্রশ্নে বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত অংশ বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার হয়। ১৯৪৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক অধিবেশনে নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের সকল সদস্যের ভোটে তা অগ্রাহ্য হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এর প্রতিবাদ করে প্রথমে ছাত্র সমাজ।

২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ছাত্রসমাজ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। নব গঠিত পরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। ওইদিন হরতালকালে পুলিশের লাঠি চার্জে অনেকে আহত হন। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল আলম সহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩-১৫ মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। শুধু ঢাকা নয় ঢাকার বাইরে সর্বত্র ১১ মার্চ হরতাল ও অন্যান্য দিনের কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার প্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ও ব্যবস্থাপক সভায় রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিষয় উত্থাপনে রাজি হন।

তড়িঘড়ি করে তাঁর চুক্তি সম্পাদনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর যেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। ১৯ মার্চ জিন্নাহও ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্সে নাগরিক সংবর্ধনা, ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে মতামত দেন। জিন্নাহর ২৪ মার্চ বক্তৃতার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশনে নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সাথে ১৫ মার্চের চুক্তি ভঙ্গ করে উর্দুকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব করেন। পরিষদে বিরোধী দল এর প্রতিবাদ করলেও নাজিমুদ্দিন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন নি। যদিও শেষ পর্যন্ত পরিষদে উত্থাপিত এই প্রস্তাবটিও বাস্তবায়ন হয়নি।

১৯৪৮ সাল জিন্নাহর মৃত্যুর পর বিশেষত মার্চ মাসের পর হতে ভাষা আন্দোলন কিছু দিনের জন্য স্থিমিত থাকলেও বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হয়। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ৮ এপ্রিল থেকে ১৮ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের ধর্মঘট, মেডিকেল ছাত্রদের ধর্মঘট, জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন চলে। ১৪ জুলাই পুলিশ ধর্মঘট হয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে গুলি চলাকালে ২ জন পুলিশ নিহত হয়।

এই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান আলী ঢাকা এলে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানায়। লিয়াকত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তৃতায় সুকৌশলে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রদের মধ্য থেকে আবারও ‘না’ ‘না’ ধ্বনিত প্রতিবাদ মুখরিত হয়ে ওঠে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭