ইনসাইড ট্রেড

জ্বালানির সাথে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম


প্রকাশ: 03/02/2023


Thumbnail

ফেব্রুয়ায়রি মাসের প্রথম দিন শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়তি দাম কার্যকরের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় দিনে এসে জানা গেল, রান্নার গ্যাস, মুরগি, ডিম, ডাল ও কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধিতে ব্যয়ের চাপ আরও বেড়ে গেছে।

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সরকার গ্যাস–বিদ্যুতের মতো সেবামূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিমুখী চাপে চ্যাপটা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত। আগে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছিল, তা কমারও কোনো লক্ষণ নেই। আরেকটি দিক হলো, সরকার যেসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা–ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না।

ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ডিমের দাম বেড়েছে ডজনে ১০ টাকা। ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম গত সপ্তাহেও প্রতি ডজন ১২৫ টাকায় কেনা যেত, তা এখন কিনতে হচ্ছে ১৩৫ টাকা দরে। এ দর বড় বাজারের ডিমের দোকানের। তবে পাড়া–মহল্লার মুদিদোকানে গেলে দাম আরও বেশি দিতে হয়। বাজারে ডিমের ডজন সাধারণত ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে থাকে। কয়েক মাস ধরে দাম অত্যন্ত চড়া। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন ডিমের দাম ২৩ শতাংশ বেশি।

অনেকের জন্য পুষ্টির যোগানে বড় ভরসা ফার্মের ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে মুরগির দাম অনেকটা বেশি থাকছে। ব্রয়লার মুরগি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। গত সপ্তাহে যা ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা ছিল। খাবার ও এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরায় মুরগির দর বেড়েছে।

ব্রয়লার মুরগি মাংসের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা। গরুর মাংস ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়ার বিপরীতে ব্রয়লার মুরগির দাম সাধারণত ১৩০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে থাকে। শুধু উৎসব এবং পবিত্র শবে বরাতের সময় ১৮০ টাকার আশপাশে বিক্রি হতে দেখা যায়। কিন্তু এখন দাম প্রায়ই দ্বিশতকের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। গত অক্টোবরে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়েছিল। টিসিবির হিসাব বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন ব্রয়লার মুরগির দাম ২২ শতাংশ বেশি।

মাছের বাজারেও স্বস্তি নেই। যেসব চাষের মাছের দাম বছরজুড়ে স্থিতিশীল থাকে, সেগুলোর দরও বেড়েছে। যেমন তেলাপিয়া মাছ সাধারণত ১৫০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। এখন তা ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। টিসিবি রুই মাছের দামের হিসাব রাখে। তাদের তালিকায় দেখা যায়, গত বছর একই সময়ে যে রুই মাছের কেজি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা ছিল, সেটা এখন ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়।

ডালের মধ্যে বেড়েছে অ্যাংকরের দাম। অ্যাংকর ডাল আমদানি করা। এটি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ কেনে। গত বছরও এ ডালের দাম কেজিতে ৫০ টাকা বা তার কম ছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৫ টাকা। অন্য ডালের দামও চড়া। মসুর ডাল মানভেদে ৯৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

রান্না করতে কাঁচা মরিচ লাগেই। কাঁচা মরিচের কেজি উঠেছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। গত সপ্তাহে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় ১০০ টাকা কেজির নিচে। বেশির ভাগ সবজির কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, সবজির দাম স্থিতিশীল আছে। তবে মৌসুমের সময় দাম যতটা কমে, এবার ততটা কমেনি।

চাল, আটা ও তেল

দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল রয়েছে। আমদানি ও আমনে ভালো ফলনও দাম কমাতে পারেনি। টিসিবির তালিকায় মোটা চালের দাম ৪৬ থেকে ৫০ টাকা লেখা রয়েছে। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের মোটা চাল কিনতে দর পড়ছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। মাঝারি চালের দর ৬০ থেকে ৬২ টাকা। আর সরু মিনিকেট চাল কিনতে লাগছে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা।

জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গতকাল বলেন, বিএনপির আমলে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় মোটা চাল বিক্রি হতো। তখন একজন নারী শ্রমিক মজুরি পেতেন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। পুরুষ পেতেন ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এক কেজি চাল কিনলে তেল ও লবণ কেনার টাকা থাকত না। এখন মোটা চাল যদি ৪৮ কিংবা ৫০ টাকা ধরি...এখন একজন শ্রমিক মজুরি পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেই দিকে ধরলে তাঁরা পাঁচ গুণ, ছয় গুণ, সাত গুণ কিংবা আট গুণ বেশি আয় করেন।

চালের দাম কতটা বেড়েছে, তা বোঝা যায় টিসিবির ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের দর দেখলে। তখন মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা ও সরু চাল ৪৫ টাকা ছিল। চালের দাম কমাতে সরকার আমদানির সুযোগ দিয়েছে। শুল্ক কমিয়েছে। তবে তারপরও দাম কমাতে পারেনি।

২০২০ সালের শুরুতে খোলা আটার কেজি ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা; তা এখন কেজিপ্রতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে মানুষকে। প্যাকেটজাত আটার দাম আরও বেশি। কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। টিসিবির হিসাবে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় আটার দাম এখন ৬৬ শতাংশ বেশি।

২০২১ ও ২০২২ সালজুড়ে ভোজ্যতেলের দাম চড়া ছিল। এখনো চড়া। ২০২০ সালের শুরুতে লিটারপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০০ টাকার আশপাশে। এখন তা ১৮০ টাকার বেশি।

মসলার মধ্যে পেঁয়াজের মৌসুম চলছে। দাম নাগালে আছে। কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। দেশি রসুনের কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। চীনা রসুন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। বিক্রেতারা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ট্রাকভাড়া, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে মৌসুমের সময় দাম ততটা কমছে না, যতটা আগে কমত।

যেমন টিসিবির হিসাবে গত বছর একই সময়ের তুলনায় এখন পেঁয়াজের দাম ৪০ শতাংশ বেশি। এবার আবাদে কোনো সমস্যা হয়নি।

নির্ধারিত দর কেউ মানে না

সরকারি সংস্থাগুলো এখন ভোজ্যতেল, চিনি ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেয়। ভোজ্যতেলের দাম মাঝেমধ্যে মানা হয় না। এটা মূলত নির্ভর করে বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটির ওপর।

চিনি ও এলপিজির নির্ধারিত দর এখন মানা হচ্ছে না। গত ২৬ জানুয়ারি চিনির খুচরা মূল্য কেজিপ্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দাম আসলে কেজিপ্রতি ১১০ থেকে ১২০ টাকা। টিসিবির তালিকায়ও এ দর উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘চিনির বাড়তি দাম ঠেকাতে আমরা সক্রিয় আছি। এলপিজির দাম আজই (গতকাল) বাড়ল। বেশি নেওয়া হলে আমরা দেখব।’

অবশ্য গ্রাহকেরা বলছেন, সব সময়ই এলপিজি নির্ধারিত দামের বেশি দরে বিক্রি হয়।

গ্যাস–বিদ্যুৎ দাম ‘আরও বাড়াবে’

সরকার গত ১৮ জানুয়ারি গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়িয়েছে। বাসাবাড়ির গ্যাসের দাম না বাড়লেও তা পরোক্ষভাবে পরিবারের ব্যয় বাড়াবে। কারণ, গ্যাস পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। বিদ্যুতের দাম গত মাসে দুই দফায় ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে সরাসরি মানুষের বাসার বিদ্যুৎ বিল বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ে প্রভাব ফেলবে।

গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় ডিম ও মুরগির দাম আরও বাড়তে পারে। কারণ, গ্যাসের বাড়তি দামে পোলট্রি খাবারের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। আর বিদ্যুৎ সরাসরি খামারের ব্যয় বাড়িয়ে দেবে।

দেশে গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড হারে বাড়ানো হয়েছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা আগের ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

এসব মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা আঁচ করা যায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল মজিদের কথায়, যিনি নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখন মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেও পাঁচজনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। মাসের শেষ দিকে ধার করা লাগে।’



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭