ইনসাইড থট

ভাষা সংগ্রামের ১৮৩৫ সালের অদেখা অধ্যায়!


প্রকাশ: 06/02/2023


Thumbnail

মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসটা যেখান থেকে শুরু বা শেষ বলা হচ্ছে, আসলে তা কি সঠিক? নাকি বিকৃত এবং খণ্ডিত? ভাষা সংগ্রামকে পাকিস্তানের আমল বা ১৯৪৮-১৯৫২-এর মধ্যে সীমিতকরণের ব্যাপারটি বিস্ময়কর। বিদেশি মনীষীরা এ জন্যই বাঙালিকে বলে আত্মবিস্মৃত জাতি। বাঙালিদের এই বদনাম আজও পরিপুষ্ট। আসল সত্য বা মিথ্যা থেকে আমরা বাঙালিরা বহুদূরে অবস্থান করছি। ইংরেজ আমলেও যে মাতৃভাষার জন্য লড়ার ইতিহাস রয়েছে, তার ঠাঁই নেই ভাষা আন্দোলন বা সংগ্রামের ইতিহাসে। অথচ, ১৮৩৫ সালে মাতৃভাষা বাংলার সংগ্রামের সূত্রপাত। কলকাতা হিন্দু কলেজের ছাত্র উদয় চাঁদ সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় বা সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানান এক প্রবন্ধে। কিন্তু ইতিহাসে নেই তিনি। আশ্চর্যান্বিত হলেও কলকাতা কলেজের শিক্ষক হয়েও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর মতো একজন প্রগতিবাদী ইংরেজ বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের চেতনা জাগিয়ে তোলেন। তার অনুগামীরাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। উদয় চাঁদ যেমন বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সরকারি কাজকর্মে বাহন হিসেবে নেওয়ার দাবি জানান, তেমনি একই সময়ে আরেক ছাত্র কৈলাসচন্দ্র দত্ত এক প্রবন্ধে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, শতবর্ষ পরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণবিদ্রোহের মুখে পড়বে এবং বিতাড়িত হবে। ডিরোজিও ইংরেজি ভাষায় এমন একটি দেশাত্মবোধক কবিতা রচনা করেন, যা ছড়িয়ে দিতে বঙ্গানুবাদ করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা ছিলেন তিনি। ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ নামক একটি দ্বিভাষিক মুখপত্র প্রকাশের আগেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী এদেশে প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। এর দেখাদেখি বোম্বাইয়ে এক স্কুলশিক্ষক ফার্দুনজি নৌরজি ইয়ং বোম্বে পার্টি এবং মাদ্রাজে গজালু লক্ষ্মীনারায়ণ বাসু চেট্টি মাদ্রাজ ইয়ং পার্টি নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। ভারতে শিক্ষা প্রবর্তনের জনক মেকলে নিজেই খোলামেলাভাবে স্বীকার করেন, ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার দরজা খোলার নেপথ্যে তাদের একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল- পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুরাগী এক শিক্ষিত ভারতীয় ভদ্রবেশী সমাজ গড়ে তোলা, যারা বিপুল দরিদ্র দেশবাসীর জীবন থেকে থাকবে বিচ্ছিন্ন এবং ইংরেজ শাসনের অনুগত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘শহরবাসী একদল মানুষ সেই সুযোগে শিক্ষা পেলে, মান পেলে, অর্থ পেলে তারাই এনলাইটেন্টড আলোকিত। সেই আলোর পেছনে বাকি দেশটাতে লাগল পূর্ণগ্রহণ। স্কুলের বেঞ্চিতে বসে যাঁরা ইংরেজি পড়া মুখস্থ করলেন, শিক্ষাদীপ্ত দৃষ্টির অন্ধতায় তারা দেশ বলতে বুঝলেন শিক্ষিত সমাজকে। সেই দিন থেকে জলকষ্ট বলো, পথকষ্ট বলো, রোগ বলো, অজ্ঞানতা বলো, জমে উঠলো নিরানন্দ, নিরালোক, গ্রামে গ্রামে।’ ইংরেজ ভক্তির মোহ দ্রুত ছুটে গিয়ে দেশপ্রেমের প্রথম জাগরণ ধারালোভাবে প্রকাশ পেল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায়- ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি/ পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ’ বা ‘রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।’ ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃভাষা বাংলাতে সর্বপ্রথম রচনা করেন ছোটদের পড়বার মতো বই- বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, বেতালপঞ্চবিংশতি। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের সামনে তিনিই খুলে দেন এক নতুন পৃথিবীর দরজা। পৃথিবীর সব ধর্মের ভেতরে একটি মৌলিক ঐক্য আছে- ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন এক জীবন্ত ইতিহাস। ‘১৮৭৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চূচুরায় বসে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন ‘বন্দেমাতরম’ গানটি। ১৮৯৬ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে নিজে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাতীয়তার ভাবোদ্দীপক ধ্বনি বন্দেমাতরম সর্বজন পরিচিতি লাভ করে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী ওই ধ্বনি উচ্চারণ করে মারা যান হাসতে হাসতে। কংগ্রেস এটাকে জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হলে নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’ গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করে। যে সঙ্গীতে বঙ্গদেশের কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গকে বুকে ধারণ করতেন, সেই বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ ঘটানো হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা করেন। তার ফলে স্বদেশি আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ‘বঙ্গভবন’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনও করেন। যে কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বঙ্গভঙ্গ রদ আইন পাশ করিয়ে বাংলাকে এক করেছিল, সেই কংগ্রেসই ১৯৪৭ সালে বাংলাকে পূর্বে পশ্চিমে দুই টুকরো করে। যখন ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বাধীনতার আগেই ১৯৪০ সালে মহাপ্রয়াণ ঘটে তাঁর। কায়েদে আজমের পাকিস্তানের ভাগে অন্তর্ভুক্ত পূর্ববাংলার বাঙালিরা ২৩ বছর সংগ্রাম শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা’ গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করলেও পশ্চিমবঙ্গ আজও পরাধীন! বাংলার বিভক্তি না হলে মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর বুকে আরও ইতিহাস রচনা করতে পারত।

মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসটা যেখান থেকে শুরু বা শেষ বলা হচ্ছে, আসলে তা কি সঠিক? নাকি বিকৃত এবং খণ্ডিত? ভাষা সংগ্রামকে পাকিস্তানের আমল বা ১৯৪৮-১৯৫২-এর মধ্যে সীমিতকরণের ব্যাপারটি বিস্ময়কর। বিদেশি মনীষীরা এ জন্যই বাঙালিকে বলে আত্মবিস্মৃত জাতি। বাঙালিদের এই বদনাম আজও পরিপুষ্ট। আসল সত্য বা মিথ্যা থেকে আমরা বাঙালিরা বহুদূরে অবস্থান করছি। ইংরেজ আমলেও যে মাতৃভাষার জন্য লড়ার ইতিহাস রয়েছে, তার ঠাঁই নেই ভাষা আন্দোলন বা সংগ্রামের ইতিহাসে।

অথচ, ১৮৩৫ সালে মাতৃভাষা বাংলার সংগ্রামের সূত্রপাত। কলকাতা হিন্দু কলেজের ছাত্র উদয় চাঁদ সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় বা সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানান এক প্রবন্ধে। কিন্তু ইতিহাসে নেই তিনি। আশ্চর্যান্বিত হলেও কলকাতা কলেজের শিক্ষক হয়েও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর মতো একজন প্রগতিবাদী ইংরেজ বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের চেতনা জাগিয়ে তোলেন। তার অনুগামীরাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। উদয় চাঁদ যেমন বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সরকারি কাজকর্মে বাহন হিসেবে নেওয়ার দাবি জানান, তেমনি একই সময়ে আরেক ছাত্র কৈলাসচন্দ্র দত্ত এক প্রবন্ধে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, শতবর্ষ পরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণবিদ্রোহের মুখে পড়বে এবং বিতাড়িত হবে।

ডিরোজিও ইংরেজি ভাষায় এমন একটি দেশাত্মবোধক কবিতা রচনা করেন, যা ছড়িয়ে দিতে বঙ্গানুবাদ করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা ছিলেন তিনি। ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ নামক একটি দ্বিভাষিক মুখপত্র প্রকাশের আগেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী এদেশে প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। এর দেখাদেখি বোম্বাইয়ে এক স্কুলশিক্ষক ফার্দুনজি নৌরজি ইয়ং বোম্বে পার্টি এবং মাদ্রাজে গজালু লক্ষ্মীনারায়ণ বাসু চেট্টি মাদ্রাজ ইয়ং পার্টি নামে সংগঠন গড়ে তোলেন।

ভারতে শিক্ষা প্রবর্তনের জনক মেকলে নিজেই খোলামেলাভাবে স্বীকার করেন, ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার দরজা খোলার নেপথ্যে তাদের একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল- পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুরাগী এক শিক্ষিত ভারতীয় ভদ্রবেশী সমাজ গড়ে তোলা, যারা বিপুল দরিদ্র দেশবাসীর জীবন থেকে থাকবে বিচ্ছিন্ন এবং ইংরেজ শাসনের অনুগত।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘শহরবাসী একদল মানুষ সেই সুযোগে শিক্ষা পেলে, মান পেলে, অর্থ পেলে তারাই এনলাইটেন্টড আলোকিত। সেই আলোর পেছনে বাকি দেশটাতে লাগল পূর্ণগ্রহণ। স্কুলের বেঞ্চিতে বসে যাঁরা ইংরেজি পড়া মুখস্থ করলেন, শিক্ষাদীপ্ত দৃষ্টির অন্ধতায় তারা দেশ বলতে বুঝলেন শিক্ষিত সমাজকে। সেই দিন থেকে জলকষ্ট বলো, পথকষ্ট বলো, রোগ বলো, অজ্ঞানতা বলো, জমে উঠলো নিরানন্দ, নিরালোক, গ্রামে গ্রামে।’

ইংরেজ ভক্তির মোহ দ্রুত ছুটে গিয়ে দেশপ্রেমের প্রথম জাগরণ ধারালোভাবে প্রকাশ পেল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায়- ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি/ পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ’ বা ‘রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।’

১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃভাষা বাংলাতে সর্বপ্রথম রচনা করেন ছোটদের পড়বার মতো বই- বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, বেতালপঞ্চবিংশতি। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের সামনে তিনিই খুলে দেন এক নতুন পৃথিবীর দরজা। পৃথিবীর সব ধর্মের ভেতরে একটি মৌলিক ঐক্য আছে- ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন এক জীবন্ত ইতিহাস।

‘১৮৭৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চূচুরায় বসে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন ‘বন্দেমাতরম’ গানটি। ১৮৯৬ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে নিজে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাতীয়তার ভাবোদ্দীপক ধ্বনি বন্দেমাতরম সর্বজন পরিচিতি লাভ করে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী ওই ধ্বনি উচ্চারণ করে মারা যান হাসতে হাসতে। কংগ্রেস এটাকে জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হলে নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’ গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করে। যে সঙ্গীতে বঙ্গদেশের কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গকে বুকে ধারণ করতেন, সেই বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ ঘটানো হয়।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা করেন। তার ফলে স্বদেশি আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ‘বঙ্গভবন’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনও করেন। যে কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বঙ্গভঙ্গ রদ আইন পাশ করিয়ে বাংলাকে এক করেছিল, সেই কংগ্রেসই ১৯৪৭ সালে বাংলাকে পূর্বে পশ্চিমে দুই টুকরো করে। যখন ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

স্বাধীনতার আগেই ১৯৪০ সালে মহাপ্রয়াণ ঘটে তাঁর। কায়েদে আজমের পাকিস্তানের ভাগে অন্তর্ভুক্ত পূর্ববাংলার বাঙালিরা ২৩ বছর সংগ্রাম শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা’ গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করলেও পশ্চিমবঙ্গ আজও পরাধীন! বাংলার বিভক্তি না হলে মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর বুকে আরও ইতিহাস রচনা করতে পারত।

অথচ, ১৮৩৫ সালে মাতৃভাষা বাংলার সংগ্রামের সূত্রপাত। কলকাতা হিন্দু কলেজের ছাত্র উদয় চাঁদ সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় বা সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানান এক প্রবন্ধে। কিন্তু ইতিহাসে নেই তিনি। আশ্চর্যান্বিত হলেও কলকাতা কলেজের শিক্ষক হয়েও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর মতো একজন প্রগতিবাদী ইংরেজ বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের চেতনা জাগিয়ে তোলেন। তার অনুগামীরাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। উদয় চাঁদ যেমন বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সরকারি কাজকর্মে বাহন হিসেবে নেওয়ার দাবি জানান, তেমনি একই সময়ে আরেক ছাত্র কৈলাসচন্দ্র দত্ত এক প্রবন্ধে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, শতবর্ষ পরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণবিদ্রোহের মুখে পড়বে এবং বিতাড়িত হবে।

ডিরোজিও ইংরেজি ভাষায় এমন একটি দেশাত্মবোধক কবিতা রচনা করেন, যা ছড়িয়ে দিতে বঙ্গানুবাদ করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা ছিলেন তিনি। ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ নামক একটি দ্বিভাষিক মুখপত্র প্রকাশের আগেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী এদেশে প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। এর দেখাদেখি বোম্বাইয়ে এক স্কুলশিক্ষক ফার্দুনজি নৌরজি ইয়ং বোম্বে পার্টি এবং মাদ্রাজে গজালু লক্ষ্মীনারায়ণ বাসু চেট্টি মাদ্রাজ ইয়ং পার্টি নামে সংগঠন গড়ে তোলেন।

ভারতে শিক্ষা প্রবর্তনের জনক মেকলে নিজেই খোলামেলাভাবে স্বীকার করেন, ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার দরজা খোলার নেপথ্যে তাদের একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল- পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুরাগী এক শিক্ষিত ভারতীয় ভদ্রবেশী সমাজ গড়ে তোলা, যারা বিপুল দরিদ্র দেশবাসীর জীবন থেকে থাকবে বিচ্ছিন্ন এবং ইংরেজ শাসনের অনুগত।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘শহরবাসী একদল মানুষ সেই সুযোগে শিক্ষা পেলে, মান পেলে, অর্থ পেলে তারাই এনলাইটেন্টড আলোকিত। সেই আলোর পেছনে বাকি দেশটাতে লাগল পূর্ণগ্রহণ। স্কুলের বেঞ্চিতে বসে যাঁরা ইংরেজি পড়া মুখস্থ করলেন, শিক্ষাদীপ্ত দৃষ্টির অন্ধতায় তারা দেশ বলতে বুঝলেন শিক্ষিত সমাজকে। সেই দিন থেকে জলকষ্ট বলো, পথকষ্ট বলো, রোগ বলো, অজ্ঞানতা বলো, জমে উঠলো নিরানন্দ, নিরালোক, গ্রামে গ্রামে।’

ইংরেজ ভক্তির মোহ দ্রুত ছুটে গিয়ে দেশপ্রেমের প্রথম জাগরণ ধারালোভাবে প্রকাশ পেল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায়- ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি/ পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ’ বা ‘রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।’

১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃভাষা বাংলাতে সর্বপ্রথম রচনা করেন ছোটদের পড়বার মতো বই- বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, বেতালপঞ্চবিংশতি। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের সামনে তিনিই খুলে দেন এক নতুন পৃথিবীর দরজা। পৃথিবীর সব ধর্মের ভেতরে একটি মৌলিক ঐক্য আছে- ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন এক জীবন্ত ইতিহাস।

‘১৮৭৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চূচুরায় বসে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন ‘বন্দেমাতরম’ গানটি। ১৮৯৬ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে নিজে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাতীয়তার ভাবোদ্দীপক ধ্বনি বন্দেমাতরম সর্বজন পরিচিতি লাভ করে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী ওই ধ্বনি উচ্চারণ করে মারা যান হাসতে হাসতে। কংগ্রেস এটাকে জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হলে নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’ গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করে। যে সঙ্গীতে বঙ্গদেশের কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গকে বুকে ধারণ করতেন, সেই বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ ঘটানো হয়।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা করেন। তার ফলে স্বদেশি আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ‘বঙ্গভবন’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনও করেন। যে কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বঙ্গভঙ্গ রদ আইন পাশ করিয়ে বাংলাকে এক করেছিল, সেই কংগ্রেসই ১৯৪৭ সালে বাংলাকে পূর্বে পশ্চিমে দুই টুকরো করে। যখন ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

স্বাধীনতার আগেই ১৯৪০ সালে মহাপ্রয়াণ ঘটে তাঁর। কায়েদে আজমের পাকিস্তানের ভাগে অন্তর্ভুক্ত পূর্ববাংলার বাঙালিরা ২৩ বছর সংগ্রাম শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা’ গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করলেও পশ্চিমবঙ্গ আজও পরাধীন! বাংলার বিভক্তি না হলে মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর বুকে আরও ইতিহাস রচনা করতে পারত।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭