ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

একটি রাষ্ট্র কি কখনো দেউলিয়া হতে পারে?


প্রকাশ: 07/02/2023


Thumbnail

‘দেউলিয়াত্ব’ হচ্ছে একটি আইনি প্রক্রিয়া যা একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে ঘোষিত হয়। সাধারণত, দেউলিয়াত্ব একটি ব্যবসায় বা ব্যক্তিকে পূর্ব ঋণ মওকুফ করে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করার সুযোগ দেয়। এই প্রক্রিয়া একটি আবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় যা পাওনাদার বা দেনাদার দায়ের করে। এই প্রক্রিয়ায় বকেয়া ঋণ পরিশোধে কী সাহায্য করতে পারে তা নির্ধারণ করার জন্য দেনাদারের সমস্ত সম্পদ মূল্যায়ন করা হয়। সম্প্রতি চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে লেবনন ও শ্রীলঙ্কা। আর্থিক অচলাবস্থায় মরিয়া হয়য়ে আছে পাকিস্তান। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও উন্নত দেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় চরম বিপাকে পড়েছে তারা।

একটি দেশ কি কখনো দেউলিয়া হতে পারে?

ব্যক্তি অথবা করপোরেট ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের মতো একটি রাষ্ট্রও দেউলিয়া হতে পারে ও হয়। একটি রাষ্ট্র তখনই দেউলিয়া হয় যখন তার সরকার নির্ধারিত সময়ে ঋণ ও অন্যান্য প্রদেয় বিল পরিশোধে ব্যর্থ হয়; তবে অর্থনীতিবিদদের দাবি,  যদি কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে বলা হয়, তাহলে সেটি ভুল বলা হবে। যখন কোনো দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন তারা দেউলিয়া হয়ে যায় না; বরং তারা ঋণখেলাপি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- খেলাপি হয় সরকার, রাষ্ট্র নয়। আর কোনো রাষ্ট্র যদি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে তবে রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি নিলামে ওঠে না।

রাষ্ট্রের ঋণ খেলাপি হওয়াকে বিরল ঘটনা মনে করা হলেও, জাতীয় ইতিহাসে প্রায় সব দেশই কোনো না কোনো সময় খেলাপি হয়েছে বা তাদের ঋণ পুনর্গঠনে বাধ্য হয়েছে।  প্রথম উন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ১৮০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়েছিল গ্রীস। ১৮২৯ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি অর্ধেকের বেশি সময় ঋণ খেলাপির তালিকায় রয়েছে।  সবচেয়ে বেশিবার খেলাপি হয়েছে স্পেন। ১৮ ও ১৯ শতকের মাঝামাঝি স্পেনীয় সরকার ১৫ বার ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়। 

একটি দেশ  কি কি কারণে দেউলিয়া হতে পারে?

দেনা পরিশোধে কোনো দেশের অক্ষমতা বা অপারগত খেলাপি সৃষ্টি করে। যেমন কোনো দেশের ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার পর, নতুন দলের সরকার ক্ষমতায় এসে সাবেক সরকারের করা ঋণ পরিশোধে প্রায়ই খেলাপি করে এমন নজির রয়েছে। দেশের অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তারল্য সঙ্কটের কারণে কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্বের আরেক কারণ হতে পারে, অসচ্ছলতা। এ ছাড়া আরো কিছু কারণে একটি দেশ দেউলিয়া হতে পারে। যেমন- ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকা, ঋণ পরিশোধে খরচ সাশ্রয়ের পদক্ষেপ না নেয়া, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি।

একটি দেশ কীভাবে দেউলিয়া হয়?

সাধারণত আদর্শ বিশ্বে, সরকারগুলো তাদের কর আর বিনিয়োগ থেকে যা আয় করে, তাই তারা ব্যয় আর দায় মেটাতে খরচ করে। আবার যখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেছে ধার করতে হয়; সরকারও ঠিক তাই করে।সরকারি ব্যয় লাগামছাড়া হলে তখন সরকারকে আরো ঋণ নিতে হয়। ঋণ পেতে বন্ড ইস্যু করে সরকার। বন্ডের মেয়াদ পূর্ণ হলে এর সুদ ও আসল পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।  

একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণ মিলে হয়- জাতীয় দেনা। একে সচরাচর সার্বভৌম দেনাও বলা হয়। সরকারের ইস্যু করা বন্ডের মাধ্যমে বেশিরভাগ বাহ্যিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া হয়। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ঋণ সরকার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয় বা জনগণের মধ্যে ঋণপত্র ইস্যুর মাধ্যমেও নিতে পারে।  

সরকারের বাজেট বরাদ্দ থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করার ব্যবস্থা থাকে। এজন্য অনেক সময় সরকার টাকা বেশি ছাপায় বা করের আওতা বাড়ায়।  তবে বাহ্যিক ঋণ নিয়ে বিপদ হলো, এজন্য বাজেটে অন্যান্য রাজস্ব বৃদ্ধিকারী খাতে বরাদ্দ কমিয়ে সে অর্থ দেনা পরিশোধে রাখতে হয়। এ ঋণ শোধ করতেও হয় বৈদেশিক মুদ্রায়—যার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। 

কোনো দেশ খেলাপি হলে তারপর কী হয়?

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলে তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ঋণ দাতারা। তবে কোনো দেশ খেলাপি হলে ঋণদাতা এর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে না অথবা যে পরিমাণ অর্থ ওই দেশের সরকারের কাছে না থাকায় খেলাপি হয়েছে-তা পরিশোধে বাধ্যও করতে পারে না। যদিও উক্ত দেশের বিদেশী সম্পদের ক্ষেত্রে এই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

এই অবস্থায় দেনাগ্রস্ত দেশের জন্য ঋণদাতার  একমাত্র পথ হচ্ছে দেশটির সরকারের সাথে ঋণের শর্ত পুনরায় আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ। আলোচনার ভিত্তিতে সরকার আগে যে বন্ডে ঋণ নেওয়া হয়েছিল সেটি বাতিল করে ঋণদাতার প্রতি নতুন বন্ড ইস্যু করতে পারে, তবে নতুন বন্ডের মূল্য পুরোনোটির চেয়ে কম হয়। 

খেলাপি হওয়ার ক্ষতিকর পরিণতি

মোট ঋণের বড় অংশ পরিশোধে কোনো দেশের সরকার ব্যর্থ হলে বা ঋণ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলে- তাতে ঋণদাতার আসল ও সুদের ক্ষতি হয়। বিদেশি বেসরকারি ঋণদাতাদের পক্ষ থেকে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ কম থাকায় কোনো সরকার তাদের দেনা অবলোপন বা বাতিল করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে।

তবে সরকার খেলাপি করলে তাতে মূল্যস্ফীতি চরম রূপ নেয়, বাড়ে বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক চাপও মোকাবিলা করতে হয়। এভাবে সংকট ঘনীভূত হতেই থাকে। 

স্থানীয় ব্যাংকিং খাতে ঋণ বেশি হলে আর্থিক ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারায়। তখন আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, যাকে বলা হয় 'ব্যাংক রান'। এই বিপত্তি এড়াতে পুঁজি উত্তোলনের সীমা আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে আমানত কতখানি উত্তোলন করা যাবে- তা সরকার নির্ধারণ করে দেয়।

তবে অর্থাভাবে কোনো দেশের ভোক্তাদের মধ্যে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমতে থাকলে, বৈদেশিক বাজার দেশটির মুদ্রার ওপর আস্থা হারাতে শুরু করে। এতে যে স্থানীয় মুদ্রা মান হারানোয় যে সার্বভৌম দেনা সংকট দেখা দেয় তা গভীর অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে। 

দেনাগ্রস্ত দেশের বৈদেশিক বাজার থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়া আরেকটি বড় ক্ষতি। এসময় কেউ ঋণ দিলেও, তা দেয় অনেক চড়া সুদ ও অন্যান্য কঠিন শর্তের ভিত্তিতে। অনেক সময় কঠিন শর্ত মানতে রাজি হলেও ঋণ মেলে না। এতে ওই দেশের ক্রেডিট রেটিংসও নেতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হয়। ফলে সেদেশে বিদেশি বিনিয়োগও কমতে থাকে। 

দেউলিয়া হলে করণীয় কী?

কোনো একটি দেশে দেউলিয়া হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা (আইএমএফ) এর দ্বারস্থ হতে পারে। এছাড়া আরও অন্য উৎস থেকেও ঋণ বা সাহায্য চাইতে পারে। তারা শর্ত দেয় যে, অবস্থার উন্নতি হলে এসব অর্থ সুদসহ ফিরিয়ে দেয়া হবে। আইএমএফ অর্থের পাশাপাশি তা খরচ করার জন্য নির্দিষ্ট খাত ও কারিগরি সহায়তাও দিয়ে থাকে। তবে এর বিপরীতে খরচ কমানো, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বাণিজ্য উন্মুক্তকরণের মতো শর্ত মানতে হয় দেশটিকে। 

অনেক সময় দেউলিয়া হওয়া দেশ তার দেশের কোনো সম্পদ যেমন সেতু, বন্দর বা এমন কিছু ঋণদাতাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দিয়ে দেয়। যার মাধ্যমে তারা আয় করে ঋণ শোধ করে নিতে পারে। অথবা দেশের ভেতরে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিও বিক্রি করে দিতে পারে সরকার। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭