ইনসাইড আর্টিকেল

লক্ষ্মীপুর জেলায় পালকী এখন সোনার হরিণ


প্রকাশ: 14/02/2023


Thumbnail

গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালকী এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পালকি এখন ঠাঁই করে নিয়েছে জাদুঘরে। প্রাচীন ও মধ্য যুগের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে পালকি এখন আমাদের ইতিহাসের অংশ এক সময় নবপরিণীতা বা উঁচুদরের মানুষের বহনে পালকী ছিল অন্যতম।

 লক্ষ্মীপুর জেলা এখন আর পালকি যেনো চোখেই পড়ে না। প্রবাবশালী জমিদারদের বহনে বাহারী পালকির কদর ছিল সর্বত্র। কিন্তু এখনকার বর-কনেরা দামি গাড়িতে চড়েই শ্বশুর বাড়ি যায়। দামি গাড়িতে করে যাওয়া এখন যেন বর- কনের মডেল। পালকি একটি প্রাচীন লোকযান। যন্ত্রচালিত যানের যুগে পালকি আজ বিলুপ্ত প্রায়। এক সময় বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া ও জমিদার, নায়েব তথা সম্মানিত ব্যক্তিদের চলাচলের বাহন হিসেবে পালকী ছিল অত্যাবশ্যকীয়। পালকী ছাড়া কোন গ্রামে বিয়ের কল্পনা করা যেত না। পালকি যেন ছিল গ্রাম্য মেয়েদের বহুদিনের লালিত প্রেম ,প্রীতি আর  ভালবাসা। পালকি থাকতো গ্রাম্য নারীদের প্রতিটি অনুভূতির সাথে জড়িত। চারকোনা বিশিষ্ঠ পালকি বহন করতো চারজন সুঠাম দেহের পুরুষ। দুরত্ব ভেদে তাদের হাতে শোভা পেত লাঠি কিংবা দেশীয় অস্ত্র। ক্ষেত্র বিশেষে পালকির বাড়তি বেয়ারা ও থাকতো।

পালকি বহনের পেশাকে ঘিরে বেয়ারা সম্প্রদায় নামে আলাদা একটা সম্প্রদায়ও গড়ে উঠেছিল। হেলে-দুলে পালকি নিয়ে চলতে বেয়ারারা ‘হেইয়াহ হেইয়াহ’ রব তুলে পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো তারা। ইতিহাসের অংশ হিসাবেই স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে এই পালকির নাম কিন্তু এই আধুনিক যুগে বাংলাদেশের কোথাও আর পালকি ব্যবহৃত হচ্ছে না।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পার্বতীনগর আহলাদীনগর গ্রামের দাই বাড়ির আমেনার বাবা (আহমদ উল্লাহ)  সুন্দরী বাবা আবদুল মজিদ ও আবদুর শুক্কুরসহ গ্রামের সহিদুল্লা এবং মারফুল্লা আরও অনেকে পালকি নিয়ে নতুন বউ নিয়ে আসতো শ্বশুরবাড়ি থেকে হেলিয়া - দুলিয়া পালকি ঘাড়ে নিয়ে মুখে বোল শব্দ করতো  দূর-দূরান্তের  থেকে শুনা যেত।

বরের বাড়ি কাচাকাছি আসলে বেহারা গানের সুরে মাতি তুলতো পুরো এলাকা সে পালকি এখন আগের মত গানের সুর শুনা যায় না পালকি ও বিলুপ্তির পথে পালকি দেখা ও যায় না।

বশিকপুর ইউনিয়নের গণমাধ্যম কর্মীর জুনায়েদ আহমেদ সংবাদ সারাবেলা কে জানান কোন এক সময় পালকি ছাড়া বিয়ের কথা ভাবাই যেত না। আমি ও পালকি চড়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বউ নিয়ে আমার নিজ বাড়ি বশিকপুরে কত আসা - যাওয়া করছি। আমাদের পাশের পাটোয়ারী বাড়ির জাকির পাটোয়ারী পালকিতে চোড়ে শশুর বাড়ি  যেতো। আমরা পালকির পিছনে পিছনে দৌড়াতাম, কত আনন্দ পেতাম।

এখন যান্ত্রিক যুগে এসে পালকি সোনার হরিণ হয়ে গেছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, বিজ্ঞানের আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতীক পালকির প্রচলন। এখন আর আগের মতো পালকির ব্যবহার চোখে পড়ে না। মেয়েরা আর পালকিতে চড়ে বিয়ের স্বপ্ন বোনে না। বিয়েতে পালকির সেই স্থান দখল করে নিয়েছে জাঁকজমক সাজানো প্রাইভেটকার।

গ্রামবাংলার প্রকৃতির সঙ্গেই মিশে ছিল পালকি। গ্রামের মেঠোপথ ধরে বেয়ারারা গানের সুরে পালকি নিয়ে চলেছেন। চার বেহারার পালকি করে, যায় রে কন্যা স্বামীর ঘরে। পালকির ভেতর থেকে নববধূ উঁকি মেরে দেখছেন। এ যেন এক অপরূপ দৃশ্য। কান্নাভেজা নয়ন, তবু যেন নতুনত্বের এক স্পন্দন ছিল।

কোনো এক সময় দেখা যেতো, গ্রামাঞ্চলের একজন কৃষকের মেয়ের বিয়েতেও পালকি ব্যবহার করা হতো। তখনকার দিনে এই পালকির উপরেই, অনেকের আয়রোজগারের একমাত্র পথ ছিল। তাদের পেশাই ছিল এই পালকি বহন করা। । একসময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালকির ব্যবহার কমতে শুরু হয়। থেকে যায় শুধু যেকোনো পারিবারিক বিয়ে সাদির অনুষ্ঠানে এই পালকির প্রচলন। যুগে যুগে ক্রমশ সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি হতে থাকে। বাড়তে থাকে বেবিট্যাক্সি, ট্যাক্সি, বাস, রিকশার মতন নানারকম ছোটবড় যানবাহন।

লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর, রামগতি, কমল নগর, রামগঞ্জ , চন্দ্রগঞ্জ,  পালকি প্রাচীনকাল থেকেই একটি বিলাসবহুল বাহন হিসেবে পরিচিত। কোন একসময়  বাংলার জমিদার শ্রেণি বা ধনীগোষ্ঠীর লোকেরা পালকির মাধ্যমে যাতায়াত করত। বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানেও বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং পরবর্তী সময়ে সেনাদের যাতায়াতের অন্যতম একটি বাহন ছিল এই পালকি। মোগল ও পাঠান আমলেও সুলতান-বাদশা-বেগমদের পালকিতে যাতায়াতের প্রথা চালু ছিল। বাংলায় ব্যবহৃত পালকিগুলোর যেগুলো ছোট আকারের হতো সেগুলোকে ডুলি বলা হতো এবং এই পালকিগুলোর বাহক থাকত ২ জন।

এসব বেহারার সাজপোশাকও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। ১৯২৯ সালে রিকশার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগব্যবস্থা যত প্রসারিত হয়, মোটর ও অন্যান্য যান যত প্রচলিত হয়, পালকির ব্যবহার তত কমতে থাকে। এভাবে বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এখনও কোথাও কোথাও শখের বসে কিংবা ভিন্নভাবে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে অনেকেই পালকির খোঁজ করেন। এই পালকি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বাংলার মানুষের হাজার বছরের ঐতিহ্য হয়ে চিরকাল রয়ে যাবে



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭