লিট ইনসাইড

আবুল হাসনাৎ মিল্টনের ‘নুসরৎ’ উপন্যাস প্রাত্যহিকের অনুপুঙ্খ সন্ধান


প্রকাশ: 16/02/2023


Thumbnail

“এবারকার গল্প বানাতে হবে এ-যুগের কারখানা-ঘরে।” চোখের বালি-র সূচনায় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবুল হাসনাৎ মিল্টনের পাঞ্জেরী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত উপন্যাস পড়তে গিয়ে একথা বলা চলে যে  ‘যুগের কারখানা-ঘর’ থেকেই এর সৃষ্টি। সময়, তার গায়ে লেপ্টে থাকা সামাজিক, ব্যক্তিগত ও চিন্তন জগতের ক্ষত আর ভাঙনের গল্প নিয়েই লেখকের এই সৃষ্টি। ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিলেন। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ এর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করা হয়।  ৬ এপ্রিল ২০১৯ সকালে অধ্যক্ষ তার অনুসারীদের হত্যার প্ররোচণা দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করে।  নুসরাত এর ভাষ্য মতে  মাদ্রাসার তিনতলায় তাকে নিয়ে গিয়ে হাত মোজা, পা মোজাসহ বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাজি না হওয়ায় তারা নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও ওড়না দিয়ে নুসরাতের পা বাঁধে, তারপরে কেরোসিন তেল গ্লাসে করে নিয়ে নুসরাতের শরীরে ঢেলে নুসরতের শরীরে আগুন দেয়। নুসরাতের শরীরের ৮০% শতাংশই ঝলসে গিয়েছিল। ১০ এপ্রিল ২০১৯ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাত এর মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার ক্ষত এখনও মোছে নি বাংলাদেশের বুক থেকে। এই প্রেক্ষিত লেখক বেছে নিয়েছেন তার উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে। যদিও তিনি প্রথমেই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ উল্লেখ করেছেন - এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক। কিন্তু উৎসর্গপত্রে লিখেছেন - অন্যায়ের বিরূদ্ধে আমৃত্যু প্রতিবাদী নুসরাত জাহান রাফিকে।

এবার আসি উপন্যাসে। “তিনি শুধু কাঁদাতে পারেন, ভাবাতে পারেন না”— শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে এই নালিশ তখনকার পাঠকদের ছিল। কিন্তু চোখের জলে ভেসে সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখা ঔপন্যাসিকের সংখ্যা কম নয়। এই পরিচিত পথে পাঠক হেঁটে চলেছে বহু প্রজন্ম। কিন্তু আবুল হাসনাৎ মিল্টন নতুন শিক্ষার অভিঘাতে সমাজ-সংসারে আলোড়নের ছবি এঁকে একদিকে পাঠককে কাঁদিয়েছেন, আবার তথাকথিত এলিটদের ভাবিয়েছেন। তাঁর লিখন, শিল্পের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতার মেলবন্ধনের যথার্থ উদাহরণ। সত্যের উদ্ভাস সেই লিখনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। অত্যন্ত গতিময় এই উপন্যাসের এক উজ্জ্বল দিক হল এর সংলাপ। এই সংলাপই পাঠকের সামনে মাদ্রাসা নামক শিক্ষাক্ষেত্রের যে সাংগঠনিক তথ্য তুলে ধরে, তার সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষেরই সম্যক পরিচয় নেই। গল্পের প্রেক্ষিত যেহেতু বর্ণনা করেছি তাই মূল গল্প পাঠক বইটি কিনে পড়ে নেবেন আশা রাখি। কিন্তু কয়েকটি মুন্সীয়ানার কথা না বললেই নয়। তেরো অধ্যায়ে বিভক্ত উপন্যাসের অধ্যায়কে তিনি উপবিভাজিত করেছেন সেটা উপন্যাস লেখায় পাকা হাত ছাড়া সম্ভব নয়। একই সাথে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে তার উপন্যাসে। তিনি লিখছেন – ‘বাংলাদেশ সরকার তাদের ঠাঁই দিয়েছে। এ জন্য তারা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের কাছে মায়ের মতন।‘ রাজনৈতিক মতের অনুপ্রবেশ যে কোন উপন্যাসকে একদেশদর্শী করে তোলে। এখানে সাবধানতা নেওয়া ভাল। যদিও তিনি সরকারীদলের স্থানীয় নেতার সাথে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বৈষয়িক আঁতাতের কথা নিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক আদর্শের দুজনের মানুষের স্বার্থের ঐক্য বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতাও। লেখক হিসেবে তার এই নির্মোহ অবস্থান প্রশংসনীয়। সাংবাদিকের আদর্শ ভূমিকার কথা সোচ্চারে বর্ণনা করেছেন লেখক। এত বজ্জাতি, বাস্তবতা এবং গদ্যশৈলীর জাদু নিয়ে শেষ অবধি এ এক চমৎকার উপন্যাস। মুসলমান সমাজ ও জীবনের বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক ও একই সঙ্গে প্রাত্যহিকের অনুপুঙ্খ সন্ধান এই উপন্যাস। দুই বাংলার কথা মাথায় রেখেই দাবি করা যায়, এমন উপন্যাস দুর্লভ। মিল্টন প্রধানত কবি, তবে তাঁর গদ্যের হাতও দুর্দান্ত। সেটাও পুনর্বার প্রতিফলিত হল ‘নুসরাত’ উপন্যাসে। বইটা পড়া শুরু করলে শেষ না করে ওঠা ভার। যেমন গল্পের গাঁথুনি, তেমনি ভাষার প্রাঞ্জলতায় সমৃদ্ধ এবারের বইমেলার অন্যতম উপন্যাস ‘নুসরাত’।

আমি ‘নুসরাত’ উপন্যাসটির বহুল প্রচার কামনা করছি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭