ইনসাইড আর্টিকেল

এক রাতে তৈরি ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার


প্রকাশ: 23/02/2023


Thumbnail

‘অশ্রুমেশা আমাদের সেই প্রথম শহীদ মিনার- যদিও আজ দাঁড়িয়ে নেই আর, বর্তমানের মিনারেই তো রয়েছে স্মৃতি তার- আর স্মৃতিতে আজও আছেন পিয়ারু সরদার!’- ‘পিয়ারু সরদার স্মরণে’ অমর চরণটি লিখেছিলেন সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। ভাষা আন্দোলন ও ঢাকায় একুশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের পেছনে এক অনন্য কারিগর ছিলেন পুরান ঢাকার প্রভাবশালী সরদার, পিয়ারু সরদার।

উনিশশো বাহান্নো সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালায় তৎকালীন পাকিস্তানী পুলিশ। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলিতে প্রথম প্রাণ হারিয়েছিরেন রফিক উদ্দিন। ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সেখানেই ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার।

ভাষা সৈনিকদের মতে, ২১ তারিখের পর ২২, ২৩ তারিখেও শহরময় গোলমাল চলছিল। এর মধ্যে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা পরিকল্পনা করেছিলেন, একুশের প্রথম শহীদ যেখানে শাহাদত বরণ করেছেন, রফিক উদ্দিন, সেখানে তারা একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে।

নকশা-পরিকল্পনা এবং নির্মাণকাজ

শহীদ মিনার স্থাপনের পরিকল্পনা ও নকশা নিয়ে ২০১৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ভাষা সৈনিক ডাঃ সাঈদ হায়দারের লেখা একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘২৩ শে ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত; শ্রান্তি নিরসনের।’

তিনি লিখেছেন, ‘তবে এখানে-ওখানে ছোটখাটো জটলা-আন্দোলন এগিয়ে নিতে আর কী করা যায়, তারই আলোচনা। ..........সামনে এলো একটা প্রস্তাব, শহীদদের শেষকৃত্য যখন আমাদের করতে দিল না, তাহলে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের হোস্টেল অঙ্গনেই একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানাই না কেন?ঠিক হলো যে শোরগোল করে নয়, যথাসম্ভব নীরবে-নিভৃতে ২৩শে ফেব্রুয়ারির এক রাতেই নির্মাণকাজটি সমাধা করতে হবে।’

তিনি লিখেছেন, ‘নকশা আঁকার ভার দেওয়া হয়েছিল বদরুল আলমের ওপর। এ কাজে তার দক্ষতা ও সক্ষমতা দুই-ই ছিল। সে যে নকশা নিয়ে আসে, শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় তা অতীব সুন্দর; কিন্তু দুটি বাঁক থাকায় ঢালাইয়ের প্রয়োজন হবে বলে এক রাতে শেষ করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতেই আমি জড়িয়ে পড়ি কাজটার সঙ্গে। আমি একটা মোটামুটি নকশা (এঁকে) দেখালাম বরুকে (বদরুল আলমের ডাকনাম)। ......এই সহজ-সরল প্ল্যানটা শুধু ইট-সিমেন্টেই শেষ হবে বলে সহজসাধ্য। বদরুল আলম বরুরও পছন্দ হলো।’

শহীদ মিনার নির্মাণ কাজে ব্যস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা। 

ভাষা শহীদদের স্মরণে দেশের প্রথম শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উঁচু আর ছয় ফুট চওড়া।

সাঈদ হায়দার লিখেছেন, ‘ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি জিএস শরফুদ্দিনের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা ছিল, তার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়। দিনেই নির্মাণের স্থানটা নির্বাচিত হয়েছিল ১২ নম্বর শেডের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাকের) পাশে, ছাত্রাবাসের নিজস্ব রাস্তার পাশে, যেখানে গুলিতে নিহত হয় প্রথম ভাষা শহীদ। মাত্র একজন পারদর্শী রাজমিস্ত্রির কুশলী হাতে নকশা মোতাবেক কাজ শুরু হলো, মিস্ত্রির একজন হেলপার ছিল বটে। কিন্তু আমাদের ছাত্রকর্মীরাই তো সেদিন সবচেয়ে সক্রিয় জোগালে (সহকারী)। মাত্র কয়েক মিনিটেই আল হাসিম ও মনজুরের সবল হাতে কোদালের কোপে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাঁচ ফুট গভীর মাটি কাটা শেষ হলো।’

লেখক এবং নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের মতে, ‘পিয়ারু সরদার সেখানে কন্ট্রাক্টর ছিলেন, তার একটা গুদাম ছিল। সেখান থেকেই মালামাল নিয়ে ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে রাতারাতি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়।’

এ বিষয়ে সাঈদ হায়দার বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য সেখানে স্তূপাকারে রক্ষিত ইট ছাত্ররাই লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে নিয়ে এলো, বালু আর বস্তাভরা সিমেন্ট এলো ছাত্রকর্মী আসগরের তৎপরতায় কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সরদারের স্বতঃস্ফূর্ত বদান্যতায়। হোস্টেল প্রাঙ্গণে নানা স্থানে অবস্থিত ট্যাপ থেকে বালতিতে করে পানি বয়ে এনেছে ছাত্ররাই। তারাই ইট ভিজিয়েছে, বালু-সিমেন্টের মর্টার বানিয়েছে, নির্মাণ সামগ্রী মিস্ত্রির হাতের নাগালে পৌঁছে দিয়েছে। ব্যারাকবাসী সব বিদ্যার্থীই নির্মাণকাজে হাত লাগিয়েছে।’

২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যেই গড়া হয় ঢাকায় একুশের প্রথম শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের কাজ শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। সকালে শহীদ মিনারের অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের বাবা, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের হাতে।     

২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। পিয়ারু সরদার ও তার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় প্রাদেশিক সরকারের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম আনুষ্ঠানিক শহীদ মিনার নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কামানের গোলার আঘাতে সেই শহীদ মিনারও ভেঙে ফেলে পাকিস্তানি হানাদাররা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭