ইনসাইড থট

বায়ুদূষণ নিরসনে নীতিমালা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণ ও কাউন্সিলিং প্রয়োজন


প্রকাশ: 23/02/2023


Thumbnail

সম্প্রতি কোন কোন দৈনিক কাগজে বায়ুদূষন নিয়ে বেশ লাল রঙের ব্যানার হেডলাইন দেখা গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদেপাঁচ দিন বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় স্থান করে নেয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকায় বায়ুদূষণের বিভিন্ন কারণগুলোর অন্যতম অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। একবার এক রাস্তা একটি সংস্থা কাটে। তারা যেতে না যেতেই আবার আরেক সংস্থা ওই রাস্তা কাটে।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শীতকালে আবহাওয়া খুবই শুষ্ক থাকে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের মতে শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বা পরিমানে খুবই কম হওয়ায় আমাদের দেশের মাটির উপরিভাগে আদ্রতা (Moisture) কমে যায়। ফলে ভূমির উপরিভাগে মাটির গঠন ঝুরঝুরে হয়ে যায়। তখন ধুলাবালি শুকিয়ে গিয়ে উড়তে থাকে। বায়ুচাপ এই সময়টাতে কমে যাওয়ায় ধুলাবালি বেশি দূরে না গিয়ে স্থলভাগের কাছাকাছি বা বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে উড়তে থাকে। জোরে বাতাস প্রবাহিত হলে এই ঝুরঝুরে মাটি থেকে ধুলিকনাগুলো বাতাসের সাথে ভাসতে থাকে। বাতাস দূষিত করে। আবার রাতের কুয়াশার সাথে মিশে নীচে নেমে আসে। শীতের সকালে গ্রামে এই দূষিত বাতাস পরিষ্কার হলেও শহর এলাকার বাতাস গ্রামের মত দ্রুত পরিষ্কার হয় না। কারন উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। সারাদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে বেশ জোরেই। নির্মান কাজও চলছে পাল্লা দিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিতআমার গ্রাম আমার শহর নীতিতে গ্রামগুলোও পরিনত হচ্ছে শহরে। নির্মাণ হচ্ছে রাস্তাকালভার্ট, ব্রীজ, পাকা দালানকোঠা। এই নির্মাণ কাজে যোগান দিতে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। এই নির্মাণ খাত ইটভাটা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া কলকারখানা থেকে নিঃসারিত বিভিন্ন ধরনের কার্বন, ময়লা-আবর্জনাসহ বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া ইত্যাদিতো রয়েছেই।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৭৬ মাইক্রোগ্রাম দূষণ নিয়ে একনম্বরে অবস্থান করে ঢাকা।

সংস্থাটি বলছে, বৈশ্বিক তালিকায় সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা হলেও ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার মতই বায়ুদূষণ হয়ে থাকে গাজীপুরে। সেখানকার বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম দূষণ পাওয়া যায়। সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম ধূলিকণা গ্যাসীয় পদার্থকে সহনীয় মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ঢাকা গাজীপুরে বায়ুদূষনের যৌক্তিক কারণ রয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিল্প-কলকারখানা। টঙ্গী শিল্পাঞ্চলকে ঘিরে শুরু করে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্প কারখানা। পাশাপাশি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, গাজীপুর থেকে ইলিভেটেড হাইওয়ে নির্মাণ টঙ্গী থেকে

জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের প্রশস্থকরনসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজে মাটি খুড়াখুড়ির, সিমেন্ট-বালির ব্যবহারের কাজই বেশি। আমাদের দেশের মাটির বিশেষ গঠনের কারণেই শুষ্ক মৌসুমে নির্মানস্থলের মাটি শুকিয়ে ধূলায় পরিনত হয়, বাতাসের সাথে মিশে বাতাস দূষিত করে। বাতাসের মান ভালো রাখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। যদিও তাদের জনবলের সংকট রয়েছে, তাদের একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। এজন্য বিভিন্ন সংস্থার মাঝে সমন্বয় সহযোগিতা দরকার। এছাড়া নির্মাণ কাজে সম্পৃক্ত কনষ্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে কাউন্সিলিং প্রয়োজন। কমিটমেন্ট স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

উন্নত দেশসমূহে প্রতিনিয়ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। কিন্ত লক্ষ্য করা গেছে ইমারত নির্মাণ বা অন্যান্য নির্মাণ কাজে বা মাটি খুড়াখুড়ি করা হয় এমন যে কোন প্রকল্প স্থানটি ভাল করে ঘেরাও করে রাখে। প্রকল্পস্থান থেকে যে কোন যানবাহন বা কোন শ্রমিক বাহিরে যেতে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। প্রকল্প স্থান থেকে যানবাহন বাহিরে যেতে গাড়ীর চাকা ভালভাবে ওয়াশ করা হয়। গাড়ী চলার পথে চাকার ফাঁকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে আটকে থাকা ময়লা যদি রাস্তায় পরে যায়, তাৎক্ষণিক ভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। বাহনের গায়ে লেগে থাকা ময়লা ভালমত পরিস্কার করা হয়। কর্মরত অবস্থায় শ্রমিকদের ব্যবহৃত পোশাক পরিবর্তন করে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয়। আমাদের দেশের নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলোর মাটিবাহী ট্রাক প্রকল্পস্থান থেকে বের হওয়ার পথে কয়েকমিটার পর্যন্ত পাটের তৈরি চট বিছিয়ে রাখা হলেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। প্রায়ই সকাল বেলা রাস্তায় বের হলে চোখে পরে নির্মাণ স্থল কয়েক মিটার রাস্তার পরিস্থিতি। বুঝা যায় রাতে মাটিভর্তি ট্রাক বা বাহন  যাতায়াত করেছে। কাদা মাটি রাস্তায় লেগে একাকার।

এপর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে একটি ঘটনা বর্ননা করা প্রয়োজন। বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন ভাই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, ৫৪ নং ওয়ার্ডের পোস্তগোলা এলাকায় নিজ বাসভবনের দোতলায় বসবাস করছেন। উনার বাসার দক্ষিণ পাশে একটা জুতার কালি তৈরির কারখানা রয়েছে। কালি তৈরির কারখানা উৎপাদন চলাকালীন সময়ে কালো ধূয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারিদিকে। বাড়ীর জানালায় ব্যবহৃত পর্দাসহ ঘরের আসবাবপত্রে হালকা কাল রং ধারণ করে। স্থানীয় বাসিন্দারা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়। তোফাজ্জল হোসেন ভাই নিজেও মারাত্মক এজমা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এমনি পরিস্থিতিতে তিনি নিজে অনেক যোগাযোগ করে কোন সমাধান না পেয়ে আমার সহযোগিতা চাইলেন। তখন বন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি। তোফাজ্জল হোসেন ভাই এর একটি আবেদনপত্র নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। অপরদিকে পরিবেশ মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে জনাব তোফায়েল আহমেদ এমপি  মহোদয়ের সখ্যতা খুবই গাঢ় বিধায় তোফায়েল আহমেদ সাহেবের সুপারিশসহ আবেদনপত্রটি জমা দেওয়ার পর জনাব মন্জু সাহেব যথাযথ ব্যবস্থা নিলেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয়ও তদন্তদল পাঠালেন। তদন্তদলের সাথে আবেদনকারীও থাকলেন। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকার কারণে তদন্তদল কারখানার ভেতরে ঢুকতেই পারলেন না। তদন্ত রিপোর্ট পেশ হলো ঠিকই, কিন্তু রিপোর্টে ঠিকানায় কোন নিবন্ধিত জুতার কালি তৈরির কারখানা অস্তিত্বই নাই। অর্থাৎ কারখানাটি ভিন্ন জেলায় ভিন্ন ঠিকানায় নিবন্ধিত হওয়ায় তদন্তদল ঐস্থানে জুতার কালি তৈরির কারখানার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এখনও সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। সেই জুতার কালি তৈরির কারখানা বহাল আছে। বরং আশেপাশে আরও কয়েকটি ছোট ছোট একই ধরনের কারখানা গড়ে উঠেছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে বায়ু দূষিত থাকলে সমস্যা কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, দূষিত বায়ু থেকে সাধারণত ফুসফুসজনিত রোগ হয়। এর মধ্যে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।মানুষের মৃত্যু বাদ দিয়ে যদি কেবল আর্থিক ক্ষতি ধরা হয়, একিউআই এর মতে সেটা বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আরেক হিসাবে দেখা যায়, বায়ুদূষণে ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির প্রায় শতাংশ।

বর্তমানে ঢাকায় বায়ুদূষন নিরসনে দুই সিটি করপোরেশন কমবেশি পানি ছিটিয়ে থাকে। নির্মাণস্থলে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে ঠিকাদারকে শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া মাটি বা বালুবাহী ট্রাক চলাচলে ঢেকে রাখতে নির্দেশনা দেয়া যায়।

তবে নির্মাণকাজের সময় পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় রেখে স্পষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা বিধিমালা বাস্তবায়নকারীদের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণ কাউন্সিলিং প্রয়োজন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭