ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

বিশ্ব ভোগান্তির এক বছর; পুতিন কি তবে ব্যর্থ?


প্রকাশ: 24/02/2023


Thumbnail

করোনা মহামারির ভয়াবহতা শেষ হতে না হতেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বিশ্ব। এরই মধ্যে ইউরোপে যুদ্ধ  হতবাক করে বিশ্ববাসীকে। যুদ্ধের ফলে যথারীতি ভাগ হয়ে গেল বিশ্বশক্তি। আসতে থাকল পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা। এতে গোলা-বারুদ আর কামান-ক্ষেপণাস্ত্রের যুদ্ধ একটি ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকলেও বৈশ্বিক রাজনীতি এর সাথে যুক্ত হওয়ায় ভুগতে শুরু করল পুরো বিশ্ব। সেই ভোগান্তির এক বছর হয়ে গেল আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এর শেষ কোথায়, সেই আঁচ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।

যুদ্ধের অশনিসংকেত দেখা গিয়েছিল হামলার কয়েক সপ্তাহ আগেই। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান নিয়ে চলছিল গুঞ্জন। তবে প্রতিবেশী দেশের এ সিদ্ধান্ত নিজেদের নিরাপত্তায় হুমকি তৈরি করতে পারে মনে করে ইউক্রেনকে বারবার সতর্ক করে আসছিল রাশিয়া। এর মধ্যেই ২১ ফেব্রুয়ারি লুহানস্ক ও দনেৎস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন পুতিন।

পশ্চিমা দেশগুলো তখন ইউক্রেনকে অভয় দিয়েছিল। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকেই আশঙ্কা সত্যি করে হামলা চালান পুতিন। ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি এলাকার মানুষ স্বাধীনতা চায় দাবি করে তিনি সামরিক আগ্রাসন শুরু করেন।

হামলার পর দেখা যায় রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েই খালাস পশ্চিমা নেতারা। যে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ে পুরো বিশ্বের উপর। সময় যত গড়াতে থাকে, যুদ্ধকে আরও পাকাপোক্ত করতে থাকেন ইউক্রেনের পাশে থাকা বিশ্বনেতারা। ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বাড়াতে থাকেন। নতুন দিকে মোড় নেয় সংঘাত।

ঘটনাক্রম ও বর্তমান অবস্থা

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের হামলার ঘোষণার পরই কিয়েভে শুরু হয় বিস্ফোরণ। বাজতে থাকে সাইরেন। সীমান্তে আসতে শুরু করেন রুশ সেনারা। একপর্যায়ে কিয়েভ দখল করে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে এপ্রিলে কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েন সেনারা। মে মাসে মারিওপোল দখলে জোর লড়াই শুরু হয়। তিন মাসের বেশি সময় পর দখল হয়ে যায়।

তবে এর আগেই জুলাইয়ে সামরিক সহায়তা পাঠাতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সেপ্টেম্বরে ঘুরে দাঁড়ায় ইউক্রেন। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে জাপোরিঝিয়া, লুহানস্ক, দনেৎস্ক ও খেরসন অঞ্চল সংযুক্তির ঘোষণা দেন পুতিন। পরের মাসেই খেরসন হারাতে হয়।

যুদ্ধের কৌশল বদলান পুতিন। হামলা করা হয় জ্বালানি অবকাঠামোতে। শীতে সংকটে পড়ে ইউক্রেনবাসী। এর মধ্যেই গত মাসে সোলেদার দখল করে রাশিয়া।

হামলার এক বছর সামনে রেখে সম্প্রতি পারমাণবিক হামলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারিমূলক বার্তা দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেন।

এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, রাশিয়া কখনোই যুদ্ধে জিততে পারবে না। আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বরাবরের মতোই পশ্চিমাদের কাছে সামরিক সহায়তা কামনা করেন। 
বিবিসি বলছে, এখনো রাশিয়ার দখলে রয়েছে ইউক্রেনের লুহানস্ক, দনেৎস্ক, মারিওপোল, মেলিটোপোল। তবে দখলে নেওয়ার পরও হারাতে হয়েছে লাইম্যান, ইজিয়াম ও খেরসন।

জাতিসংঘ বলছে, এক বছরে এ যুদ্ধে মারা গেছে ৮ হাজার বেসামরিক মানুষ এবং আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩০০ জন। ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ মানবিক সংকটে পড়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ। মার্কিন অলাভজনক গণমাধ্যম সংস্থা এনপিআর বলছে, এ পর্যন্ত যুদ্ধে ২ লাখ রুশ ও ১ লাখ ইউক্রেনীয় সেনা হতাহত হয়েছেন। ৩০ হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গেছে।

তবে পূর্ব ইউরোপের এ দুই দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে এ যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের পর ফের নতুন মেরুকরণ হয়েছে বিশ্বে। এই এক বছরে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াল, সেই জলে কারা হাবুডুবু খেল, এক প্রতিবেদনে সেটিই বলার চেষ্টা করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। 

বিশ্বে আবারও মেরুকরণ

সংঘাত ও সাংঘর্ষিক অবস্থান আরও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে এ যুদ্ধ। ওয়াশিংটন ও বেইজিংকেন্দ্রিক দেশগুলোর মধ্যকার বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছিলেন, ‘আমরা একটি বহু মেরুর বিশ্বে প্রবেশ করেছি, যেখানে প্রধান অস্ত্র জ্বালানি, ডেটা, অবকাঠামো ও অভিবাসন।’

প্যারিসভিত্তিক থিংকট্যাংক এফএমইএসের প্রধান পিয়েরে রাজৌক্স বলেন, বর্তমান এ সংকটই বাস্তবতা, হয়তো সাময়িক। অনিবার্যভাবেই যুদ্ধের অবসান রাশিয়া ও ইউরোপকে দুর্বল করবে। বড় দুই সুবিধাভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

ইইউ ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক অ্যালিস একমান বলেন, চীন দূরে সরছে না। বরং রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও দৃঢ় করছে। তাঁর কথার সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার। চীনের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মস্কো সফর করেছেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফর নিয়েও কথা হচ্ছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে মন্তব্য করেছেন সি।

জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট

ফ্রিকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, উষ্ণতা ও আশ্রয়ের পেছনে ব্যয় বেড়েছে। করোনা মহামারি শুরুর আগে থেকেই জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে বৈশ্বিক সংকট ছিল। করোনার পর বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হতেই মুখ থুবড়ে পড়ে সবকিছু। রাশিয়ার ওপর একের একের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে।

জ্বালানি সরবরাহে দেখা দেয় সংকট। এ ছাড়া ইউক্রেন অন্যতম শস্য রপ্তানিকারক দেশ হওয়ায় খাদ্যশস্যেও পড়ে প্রভাব।

যুদ্ধের কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেড়ে যায় সবকিছুর দাম। দেশে দেশে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যয় কমাতে এক বেলা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে দেশবাসী।

জার্মানিভিত্তিক ফ্রেডেরিখ এবার্ট ফাউন্ডেশন এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, সবচেয়ে বেশি ভুগছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কারণ, তাদের বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে দরিদ্র দেশগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সংকট তো ছিলই।

এই যুদ্ধে কী পেলেন পুতিন?

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে অবৈধভাবে রুশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে সাফল্যের দাবি করতে পারেন তিনি, তা হলো রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত একটি স্থল সেতু স্থাপন করা। যে কারণে রাশিয়া এখন কের্চ স্ট্রেইটের ওপর নির্মিত সেতুতে নির্ভরশীল নয়।

তিনি ‘রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য অর্জন’ হিসাবে মারিউপোল এবং মেলিতোপোল শহরসহ ওই অঞ্চলটি দখলে নেওয়ার কথা বলেছেন। কের্চ স্ট্রেইটের অভ্যন্তরের আজভ সাগর ‘রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সাগরে পরিণত হয়েছে’ বলেও তিনি ঘোষণা দেন। তিনি বলেছেন, এমনকি রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেটও এটি করতে পারেননি।

পুতিন কী তাহলে সফল নন??

ক্রিমিয়ার একটি আঞ্চলিক করিডোর দখলে নেওয়ার বাইরে রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী ও বিনা উসকানির এই যুদ্ধ নিজের এবং ইউক্রেনের জন্য এক বিপর্যয় তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং অক্ষমতাই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

মারিউপোলের মতো ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরকে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে, কিয়েভের কাছের বুচাতে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধাপরাধ চালানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক একটি স্বতন্ত্র তদন্ত প্রতিবেদনে রাশিয়ার সৈন্যদেরকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭