ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গেম চেঞ্জার হয়ে আসবে চীন?


প্রকাশ: 25/02/2023


Thumbnail

গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, গোটা বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছিলো ইউরোপে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে এই খবর শুনে। ভোরের আলো ফোটার আগেই কিয়েভে আঘাত হানছিলো একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র, শহর ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছিলো হাজার হাজার মানুষ।

এর মধ্যেই ক্রেমলিন থেকে এসেছিলো রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক কঠোর হুঁশিয়ারি। “আমাদের কাজে যারাই বাধা দেবে, বা আমাদের দেশকে হুমকি দেবে, তাদের জেনে রাখা উচিৎ, রাশিয়া সাথে সাথে পাল্টা জবাব দেবে। এর পরিণতি হবে এমন, যা ইতিহাসে কেউ আগে দেখেনি” বলে শত্রুপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন পুতিন।

এই যুদ্ধের রেষ কেবল ইউক্রেন বা ইউরোপ নয়, গোটা পৃথিবীর রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতিতে জন্ম দেয় এক বিরাট অস্থিরতার। ইউক্রেন যুদ্ধের অবস্থা এখন কী? এই সংঘাতের শেষ কোথায়? এই যুদ্ধ কীভাবে পাল্টে দিয়েছে বিশ্ব পরিস্থিতি? ইউক্রেন যুদ্ধ কী আসলে আরও একটি মহাযুদ্ধের শুরু মাত্র?

প্রেসিডেন্ট পুতিন কি তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন?

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য যখন ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনে, বিশাল এক ট্যাংক আর সাঁজোয়া বহর এগিয়ে যাচ্ছে কিয়েভের দিকে- তখন ইউক্রেনের পরাজয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি দেশের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে ইউক্রেন কতদিন টিকতে পারবে, তা নিয়ে অনেকেই ছিলেন সন্দিহান। কিন্তু এক বছর পর এই যুদ্ধ এখনো চলছে। যুদ্ধ শুরুর সময় রাশিয়ার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল তিনটি। প্রথম, কিয়েভে, মস্কোর ভাষায়, যে নাৎসীবাদীরা ক্ষমতায়, তাদের উৎখাত করা; দ্বিতীয়ত ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নিরস্ত্র করা; তৃতীয়ত, ইউক্রেন যেন কোনদিন নেটো জোটের সদস্য হতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা।

যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সবাইকে যা অবাক করেছে, তা হলো রাশিয়ার মতো এক বিরাট ক্ষমতাধর দেশের সামরিক দুর্বলতা। যুদ্ধে প্রথম কিছু সাফল্য দেখালেও রাশিয়াকে ইউক্রেনের অনেক এলাকা হতে পিছু হটতে হয়েছে। রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, ইউক্রেনীয় বাহিনীও কিন্তু বেশ দুর্বল হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন নেটো জোটের কাছ থেকে বিপুল সামরিক সহায়তা পেয়েছে, আরও পাবে বলে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবায়িত হয়, ইউক্রেনের বাহিনী আরও বেশ কিছুদিন যুদ্ধ করে যাবার শক্তি পাবে। সুতরাং বলা যেতে পারে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে ন্যাটো জোটে ইউক্রেন যুদ্ধে এখনো যোগ দিতে পারেনি। যতদিন সেখানে যুদ্ধ চলছে, ইউক্রেনের কিছু অস্ত্র রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকছে, ততদিন হয়তো ইউক্রেন ন্যাটো জোটের অংশ হতে পারবে না। কাজেই বলা যেতে পারে রাশিয়া তাদের কিছু লক্ষ্য অর্জন করেছে, কিছু করতে পারেনি।

যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে কি একঘরে করা গেছে?

যুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো যে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে দুর্বল করা, একঘরে করে ফেলা। শুরুতে রুশ অর্থনীতিতে এর বিরাট ধাক্কা লেগেছিল। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো যখন একের পর এক রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটাতে শুরু করে, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো কঠিন করে তোলা হয়, তখন রুশ মুদ্রা রুবলের মানে বিরাট ধস নামে।

অন্যদিকে, ইউরোপের যেসব দেশ নেটো সামরিক জোটে যোগদানের পক্ষে একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল, সেসব দেশ একের পর ন্যাটো জোটে যোগ দেবে বলে ঘোষণা দিতে থাকে। তার মানে, যুদ্ধের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিন যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন, ন্যাটোকে ঠেকানো- যুদ্ধের কারণে তার উল্টো ফল হয়েছে কি না তা নিয়ে ভিন্ন মতামত রয়েছে।

 একদিকে ন্যাটো বলছে, রাশিয়া প্রচণ্ড-ভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক- সমস্ত দিক থেকে। বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার যে একটা বিরাট ভাবমূর্তি ছিল, সেটা নষ্ট হয়েছে। তাদের সেনাবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাজেই রাশিয়া দেখতে যতটা শক্তিধর মনে হয়, কার্যত তারা ততটা নয়।

কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশ এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলে গেলেও বাকী বিশ্ব, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলো কিন্তু সেরকম কট্টর কোন অবস্থান নেয়নি। কাজেই রাশিয়া একেবারে একাও হয়ে যায়নি।

এই যুদ্ধ কতটা বদলে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি?

নব্বুই এর দশকের শুরুতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়লো, তখন কমিউনিজমের পতনকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় বলে ঘোষণা করেছিলেন অনেকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তো “দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি এন্ড দ্য লাস্ট ম্যান” বলে একটা বই লিখে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপে আবার এক রক্তাক্ত যুদ্ধে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ব্যবস্থা উলট-পালট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন,“এই যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ধারণা ছিল, স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পর ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটবে, অর্থাৎ, ইউরোপে বোধহয় আর কোন যুদ্ধ ঘটবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব জুড়ে উদার গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আধিপত্য কায়েম হবে। কিন্তু তাদের হিসেবে একটা বড় ভুল ছিল।”

“রাশিয়ার যে আবার পুনরুত্থান ঘটতে পারে, সেখানে যে একটি পশ্চিমা-বিরোধী রুশ জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে, এই সমীকরণটা গোণায় ধরা হয়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তার অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তিকে সংহত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আসলে এক বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। বিশ্ব জুড়ে এখন যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাধান্য, এটি বজায় থাকবে কিনা, সেটাই কিন্তু এখন পশ্চিমা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা,” বলছিলেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।

তিনি বলেন, সবকিছুই এখন নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলের ওপর।

চীন যদি এই যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে দাঁড়ায় তখন কী ঘটবে?

ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে গত কদিন ধরে যে খবরটি সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, তা হলো চীনের ভূমিকা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিন্কেন বলেছেন, তাদের কাছে এমন গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, যে, চীন রাশিয়াকে হয়তো সামরিক অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিতে পারে।

সামরিক সরঞ্জামের অভাবে রাশিয়া এখন বেকায়দায় আছে। কাজেই চীন যদি সত্যি সত্যি রাশিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, তাহলে সেটিকে অনেক বিশ্লেষক একটা ‘গেম চেঞ্জার’ বলে বর্ণনা করছেন। চীন যদি এই কাজ করে, তাহলে কি পুরো পরিস্থিতি আমূল বদলে যেতে পারে?

আসলে বহু দশক ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর একটা বড় দুশ্চিন্তা ছিল, রাশিয়া এবং চীন যদি তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়, তখন কী হবে।

ইউরেশিয়া- অর্থাৎ ইউরোপ এবং এশিয়া, দুই মহাদেশ জুড়ে যে বিশাল ভূখণ্ড, সেখানে যদি কোনদিন একটি দেশ, বা একাধিক দেশের মৈত্রী জোট যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটা বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্যেই কিন্তু পশ্চিমা শক্তি রাশিয়াকে চীন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। তারা চীনকে একঘরে করে চীন বিরোধী সংগ্রামের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোকে এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া এখন চীনের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন রাশিয়াকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেবে কিনা, বা কতদূর দেবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। চীন তাদের মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেবে। যদি চীন এবং রাশিয়া সত্যি একটি মৈত্রী জোটে পরিণত হয়, যেখানে ন্যাটো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে দিচ্ছে, তখন বিশ্ব রাজনীতিতে একটা বিরাট বিভাজন বা দ্বি-মেরুকরণ দেখা যাবে। এর একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোট, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া এবং তাদের সহযোগী দেশগুলো। যা হবে বিশ্ব রাজনীতির জন্য খুবই বিপদজনক এক মোড়।

এই দুই মেরুর দেশগুলোর মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছে, যাদের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ, এই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের শক্তি, ক্ষমতা এমনকি ইচ্ছে পর্যন্ত যাদের আছে, সেখানে গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭