এডিটর’স মাইন্ড

বিএনপির পদযাত্রার গন্তব্য কোথায়


প্রকাশ: 27/02/2023


Thumbnail

নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। এ কর্মসূচি এখন পদযাত্রাকেন্দ্রিক। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জেলায় জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছে ১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। এ পদযাত্রা কর্মসূচি থেকেই আগামী ৪ মার্চ জেলা এবং মহানগরীতে বিক্ষোভ ও পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করাসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি মূলত শুরু হয় গত বছর অক্টোবর থেকে। এ সময় প্রতিটি সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশ করে দলটি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় ছিল সর্বশেষ সমাবেশ। এ সমাবেশের স্থান নিয়ে সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হয়। ৮ ডিসেম্বর সমাবেশের দুদিন আগে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের নেতাকর্মীরা জমায়েত হতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। সেখান থেকে বেশ কজন নেতাকর্মীকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ গোলযোগের সূত্র ধরেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগে সমাবেশ করে বিএনপি। ওই সমাবেশ থেকে বিএনপির সাত এমপি পদত্যাগ করেন। বিএনপি আশা করেছিল এ পদত্যাগের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের গতি বাড়বে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক মহলে বর্তমান সংসদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কিছুই হয়নি। বিএনপির সংসদ সদস্যদের শূন্য আসনে দ্রুত নির্বাচন হয়। সেখানে নতুন সংসদ সদস্যরা এরই মধ্যে শপথ নিয়ে সংসদেও বসেছেন। বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ করা গিয়েছিল। অনেকেই ধারণা করেছিল, এরপর বিএনপির আন্দোলন আরও বেগবান হবে। আন্দোলন সরকারকে চাপে ফেলবে। কিন্তু বাস্তবে বিএনপির আন্দোলন পদযাত্রায় বন্দি হয়ে আছে। বিএনপি কখনো ইউনিয়নে, কখনো মহানগরীতে, কখনো বা ঢাকায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে। রাজনীতি সম্পর্কে যারা ন্যূনতম খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, এ ধরনের কর্মসূচি দিয়ে আর যাই হোক, সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা যায় না। এখন পর্যন্ত ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বিচলিত নয় বিএনপির আন্দোলনে। বরং বিএনপির কর্মসূচি যেন জনগণের জানমালের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করছে বিএনপির কর্মসূচির দিন। আওয়ামী লীগ মাঠে থাকছে। এর ফলে রাজনীতির মাঠে উত্তেজনা বাড়ছে বটে, কিন্তু মাঠ দখলের বিএনপির কৌশল অকেজো হয়েছে। আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিয়েছে, মাঠের শক্তিতেও তারা কম যায় না। এসব কর্মসূচি ক্ষমতাসীনদের জন্যও সাপে-বর হয়েছে। নেতাকর্মীরা কাজ পেয়েছে। দল সংগঠিত করার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলনে অভ্যস্ত ও অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ। দলটি ভালো করেই জানে ‘পদযাত্রা’ করে সরকারের পতন ঘটানো অসম্ভব। এ জন্য মাঠ দখল করে নির্বাচনের আগে শক্তি পরীক্ষা করে নিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপিও ভালো করেই জানে তাদের আন্দোলনের সময় ফুরিয়ে আসছে। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে পবিত্র রমজান শুরু হবে। এ সময় ঐতিহ্যগতভাবেই সব রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বন্ধ থাকে। সিয়াম সাধনার এ মাসে রাজনীতি হয় ইফতার পার্টিকেন্দ্রিক। এরপর বর্ষাকাল। তারপর ঈদুল আজহা। কাজেই বিএনপির ১০ দফার মধ্যে প্রধান দাবি অর্জনের সময় আর নেই। নানা বাস্তবতায় বিএনপি এখন হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওর মতো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। ২০১৩, ’১৪ ও ’১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। জ্বালাও-পোড়াওর মাধ্যমে জনআতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে। অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিয়ে নিজেরাই নিজেদের করেছে ঘরবন্দি। এর ফলে বিএনপি সমালোচিত হয়েছে, হয়েছে নিন্দিত। তীব্র সমালোচনার মুখে বিএনপিকে তার কর্মসূচি থেকে পিছু হটতে হয়েছে। বিএনপির এ সর্বনাশা কর্মসূচির কারণে জনগণের মধ্যে সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। জনগণ এসব কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে। আন্তর্জাতিক মহল থেকেই এ ধরনের কর্মসূচিকে পরিহার করার আহ্বান জানানো হয়। ফলে বিএনপি এখন চাইলেও আবার সহিংস কর্মসূচিতে ফিরে যেতে পারছে না। বিএনপি তার আন্দোলনে যতটা না জনসমর্থন চায়, তার চেয়ে বেশি চায় আন্তর্জাতিক সহানুভূতি। বিএনপি এখন পর্যন্ত তাদের কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এর মানে এই নয় যে, আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো অস্বস্তি নেই। সমালোচনা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, কোথাও কোথাও আওয়ামী পাতি নেতাদের দানব হয়ে ওঠা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে, আছে হতাশা। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিএনপির ওপরও আস্থা রাখতে পারছে না। বিএনপির নেতা কে? বিএনপি ক্ষমতায় এলে আদৌ ভালো কিছু করতে পারবে? এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। বিএনপির অতীত সাধারণ মানুষের অজানা নয়। হাওয়া ভবন, ১০ ট্রাক অস্ত্র, বাংলাভাইসহ জঙ্গিবাদের উত্থান সব মানুষ ভুলে যায়নি। বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। সারের জন্য কৃষকের রক্ত। পূর্ণিমা, ফাহিমার ধর্ষণ। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের দুপক্ষের গোলাগুলিতে মেধাবী ছাত্রী সনির নির্মম মৃত্যু। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এসব দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ঝাপসা হলেও মানুষ ভুলে যায়নি। তাই সামান্যসংখ্যক সাধারণ মানুষ মনে করে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো দেশ চালাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তুষ্ট, হতাশ হলেও শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল। শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা মানুষের কল্যাণ চান। বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং অর্জন তার একক শক্তিতে এবং সাহসে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। দেশের সিংহভাগ জনগণের এ উপলব্ধির কারণেই বিএনপির আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা নেই। আমার মনে হয়, বিএনপি নেতারা তাদের আন্দোলনে জনগণকে যতটা না সম্পৃক্ত করতে চান, তার চেয়ে তাদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ। বিএনপি রাজপথে প্রতি সপ্তাহে যতটুকু সময় ব্যয় করেছে, তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছে গুলশান-বারিধারা কূটনৈতিকপাড়ায়। কূটনীতিকদের কড়া অনুশাসনের কারণে দলটি কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে না। বিএনপির কর্মসূচির একটি প্রধান লক্ষ্য পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ। প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি বিএনপির দাবি আদায় করে দিতে পারবে? পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। এ ব্যাপারে তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা খোলামেলাভাবেই বলা হচ্ছে। প্রতি মাসেই একজন করে মার্কিন কূটনীতিক ঢাকায় আসছেন। নির্বাচন নিয়ে তাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। এটাই বিএনপির আশার প্রদীপ। বিএনপি ভাবছে, যত বেশি তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করবে, ততই যুক্তরাষ্ট্র ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের’ কথা বলবে। এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ’১৮-এর মতো হবে না। বিএনপি মনে করতেই পারে তারা যদি নির্বাচন থেকে দূরে থাকে তাহলেই অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। বিএনপি এবং তার সহযোগীদের বাদ দিয়ে নির্বাচন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বিএনপির পদযাত্রার আপাত দৃশ্যমান গন্তব্য হলো, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি। একটি সাংবিধানিক শূন্যতার তৈরি। আরেকটি এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করা। কিন্তু তাতে বিএনপির লাভ কী? বিএনপির নেতারা এ প্রশ্নের উত্তর দেন কোনো ভণিতা ছাড়াই। তাদের মতে, আওয়ামী লীগকে বিদায় করাটাই তাদের লক্ষ্য। আওয়ামী লীগের বদলে যে কেউ এলেই তারা খুশি। এ জন্যই বিএনপির আন্দোলন কৌশল এখন অনেকটা সুশীল ঘরানার। সুশীল এবং পশ্চিমাদের সন্তুষ্টির আন্দোলন করছে দলটি। কিন্তু পদযাত্রার মিছিল যদি একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনে, তাহলে কি বিএনপির লাভ হবে? এক-এগারোতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল বিএনপি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়া। তাই আবার অনির্বাচিত শক্তি ক্ষমতা দখল করলে বিএনপি বিলীন হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? নাকি বিএনপির ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে এক-এগারোর শক্তি। তাদের ইশারায় বিএনপি একটি অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় আনার ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। আত্মঘাতী খেলায় মেতেছেন বিএনপির কতিপয় নেতা।

তবে বিএনপির লক্ষ্য যে এটাই, তা কি নিশ্চিত করে এখনই বলা যায়? অবশ্যই না। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে না যাবে না বলে আওয়ামী লীগের সামনে আচমকা নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ নিয়ে দাঁড়াতে চায়? কারণ পদযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি মামুলি কর্মসূচির আড়ালে বিএনপি যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা আর গোপন নেই। তাহলে কি আওয়ামী লীগকে চমকে দেওয়ার জন্যই বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা? এটাই কি তাদের কৌশল। কারণ শুধু বিএনপি নয়, সব প্রতিপক্ষই জানে, আওয়ামী লীগ তখনই বিপর্যস্ত ও পরাজিত হয়, যখন দলটি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয় এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দুই রোগের উপসর্গ এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে ভালোভাবেই দৃশ্যমান। এ সুযোগটা বিএনপি নিতে চাইবে না, তা কী করে হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলছেন, আগামী নির্বাচন কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক মহল আগামী নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই চোখ-কান খোলা রেখেছে। নির্বাচন কমিশন যে সরকারের একান্ত অনুগত থাকবে না, তা এরই মধ্যে জানান দিয়েছে। এরকম পরিস্থিতি, বিগত দুটো নির্বাচনে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন আওয়ামী লীগের বেপরোয়া নেতা এবং এমপিরা কী করে বৈতরণী পার হবেন? তবে এবার নির্বাচনের আগের রাজনীতি আসলে মাঠের শক্তি পরীক্ষা না। এটা কৌশলের লড়াই। কৌশলের লড়াইয়ে বিএনপির পদযাত্রা কোন গন্তব্যে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭