ইনসাইড আর্টিকেল

‘মার্চের উত্তাল দিনগুলো’: মার্চের প্রথম দিন- ১ মার্চ, ১৯৭১


প্রকাশ: 01/03/2023


Thumbnail

আজ ১লা মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুত্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যমণ্ডিত মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ ছিল বাংলাদেশের জন্ম মুহূর্তের লগ্ন। মার্চ মাস একটি নতুন পতাকা জন্মের মাস, মার্চ মাস একটি নতুন মানচিত্র তৈরির মাস। বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের মাস। বাংলাদেশের জন্ম হয় এই উত্তাল মার্চেই। উত্তাল মার্চের দিনগুলো ছিল বাংলার সংগ্রামী জনতার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় শামিল হওয়ার ক্ষণ। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র প্রথম পর্বে থাকছে ১লা মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।

১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে নির্বাচিত দলের সঙ্গে নানা কূটচাল শুরু হয়। একাত্তরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয়েছিল, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ৩ মার্চ। কিন্তু পয়লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিক এক বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

এদিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি আগামী ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তারা যেহেতু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পরিহার করতে চেয়েছেন সুতরাং জাতীয় পরিষদই ভেঙে যেতে পারত। এরপরও আমরা যদি ৩ মার্চ উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য এগিয়ে যাই তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমগ্র চেষ্টাই নষ্ট হয়ে যেত। সংবিধান রচনায় একটি যুক্তিসঙ্গত বোঝাপড়ায় আসার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের আরও সময় দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। পাকিস্তানের কয়েকটি দলের কঠোর মনোভাব ছাড়াও ভারত যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার ফলে সমস্ত ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমি পরবর্তী ১ তারিখের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

এর আগে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনা করার কথা বললেও ভুট্টো আরও আলোচনার কথা বলেছিলেন। তিনি চান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে হোক। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ঠিক করেছিলেন।

১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি তাদের ৬ দফার ব্যাপারে আপোষ বা পরিবর্তন না করে- তবে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসতে পারি না।’

১৯ ফ্রেব্রুয়ারি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বলেন, ‘শেখ মুজিব যদি শর্ত না মানে তবে আমরা কোনভাবেই অধিবেশনে যোগ দিতে পারি না।’

১ মার্চ বেতারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার খবরে রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষুব্ধ মানুষ। সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে চলমান আন্তর্জাতিক একাদশ এবং বিসিসিপির মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচটিও বন্ধ হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের দর্শকেরা রাস্তায় নেমে আসেন। মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। বন্ধ হয়ে যায় বিমান চলাচল। কেবল বেসরকারিই নয়, সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাস্তায় নেমে আসেন।

অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম কালো দিন। এই সিদ্ধান্ত জনবিরুদ্ধ ও প্রতিহিংসামূলক। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে চক্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

এদিকে ছাত্র জনতা তখন মিছিলে শামিল হয়ে হোটেল পূর্বাণীর দিকে জড়ো হয়। হোটেল পূর্বাণীতে চলছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যদের বৈঠক। যেখানে ৬ দফা দাবির ওপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। এরই মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল পৌঁছে হোটেল পূর্বাণীর সামনে। বাইরে তখন স্লোগানের পর স্লোগান দিচ্ছিল সাধারণ জনতা। পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করেন। 

এ সময় তিনি বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য সারা বাংলাদেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন। জনাব ভুট্টো ও জনাব কাউয়ুম খানের দল ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি সকল সদস্যই অধিবেশনে যোগ দিতে রাজি ছিলেন। ......বাংলার মানুষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে।’

 এই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ সমগ্র ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র বাংলায় হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আগামী ৭ মার্চ জনসভাতেই তিনি পরবর্তী পরিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করবেন।’

১ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়। এদিন রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে পরবর্তী কর্মসূচি ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন। 

১ মার্চ পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম পন্থী) প্রধান আবদুল কাইয়ুম খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণাকে সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করলে দলের সাধারণ সম্পাদক খান এ সবুর সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

১ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নেতারা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের প্রতিবাদে ২ মার্চ যে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানিয়েছিল প্রেসিডেন্টের পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের নতুন বিবৃতির পর তা প্রত্যাহার করে নেয়। 

১ মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা এম এম ইয়াকুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন। এদিন গভীর রাতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা এম এম ইয়াকুব খান ১১০ নম্বর সামরিক আইন আদেশ জারি করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী সংবাদ, খবর, মতামত এবং আলোকচিত্র প্রকাশের বিষয়ে সংবাদপত্রের উপর বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে তিনি আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি স্বরূপ ২৫ নম্বর সামরিক আইনবিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন।

(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২ মার্চ ১৯৭১)।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭