ইনসাইড পলিটিক্স

রাজনৈতিক সমঝোতা: উল্টো পথে হাটছে হেফাজতে ইসলাম


প্রকাশ: 01/03/2023


Thumbnail

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠ্যবই সঙ্কট এবং কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ওঠেছিল, হেফাজতে ইসলাম বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর বলয়ে বিচরণ করছে। কিন্তু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। বাস্তবিক পক্ষে ঘটনাটি ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে উল্টো পথেই হাটছে হেফাজতে ইসলাম। সেক্ষেত্রে সংগঠনটি তাদের নিজ বলয়ে থেকেই নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচেছ। মোটকথা বিএনপি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের সাথে সমঝোতা এবং কারাবন্দি নেতা-কর্মীদের মুক্তি।        

সূত্র জানায়, এক সময়ে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক যোগাযোগ অত্যন্ত গভীর থাকলেও এখন আর সেই অবস্থান নেই। মাওলানা মামুনুল হক সক্রিয় ভূমিকায় থাকার সময়ে বিএনপির সাথে মামুনুল হকের যোগাযোগ এবং সখ্যতা গভীর ছিল। যে কারণে সে সময়ে হেফাজতে ইসলাম বিএনপির সাথে তাল মিলিয়ে অনেকটা গা ঘেঁষে চলেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তারা রাজনীতি করছে। বিএনপির সাথে তাদের কোনো যোগসূত্র নেই বলেই জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি সরকার বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রভৃতি ১০ দফার আন্দোলন করে যাচ্ছে। আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাঁবে তখন আরও অনেক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তাতে যুক্ত হবে। হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। হেফাজতের সঙ্গে এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামি দলের সঙ্গে বিএনপির কোনো আলোচনা হয়নি।

অবশ্য বিএনপির কিছু নেতার এমন আশাবাদের বিপরীতে হেফাজতে ইসলামের এক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপি কী আশা করল না করল- তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের পথ এখন ভিন্ন। এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের দপ্তর সম্পাদক মহিউদ্দিন রব্বানী শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তাই আমাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো রাজনৈতিক যোগাযোগ হয়নি। আমাদের ঊর্ধ্বতন নেতাদের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কোনো যোগাযোগ হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান জানান, ২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতে ইসলাম। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। তখন হেফাজতের পক্ষ থেকে হতাহতের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। বিএনপি তখন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিবৃতি দিয়ে ঢাকার নেতাদের হেফাজতের নেতাকর্মী ও আলেম-ওলামাদের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা আগত আলেম-ওলামাদের খাবার-দাবার ও উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা দিয়েছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করেও রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয় ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় হেফাজতের অনেক নেতা-কর্মীদের কারাগারে নেওয়া হয়। নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে হেফাজত, যে প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে হেফাজত ‘মুচলেকা’ দিয়েছে রাজনীতি না করার। বিএনপি তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু দেশের শীর্ষ এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বিএনপির কোনো যোগাযোগ নেই। তারা তাদের কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির জন্য সরকারের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পারলাম, তারা রাজনীতি না করার বিষয়ে সরকারকে মুচলেকা দিয়েছে। পরে অবশ্য সরকারকে মুচলেকা দেয়নি বলেও গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে।’

এদিকে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা শায়খ সাজিদুর রহমান গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম রাজনীতি না করার বিষয়ে কাউকে ‘মুচলেকা’ দেয়নি। আমাদের সম্পর্কে উদ্দেশ্যমূলক গালগল্প ছড়ানো হচ্ছে। হেফাজত কখনই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না, আগামীতেও রাজনীতি করবে না। হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। নতুন করে কাউকে রাজনীতিতে না জড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া অবান্তর প্রসঙ্গ।’

বিএনপির একাধিক বয়জেষ্ঠ্য নেতারা জানিয়েছেন, ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের লক্ষ্যে বিএনপি গত বছর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। অবশ্য ইসলামি দলগুলো যেমন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম প্রভৃতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হয়নি। তবে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া প্রভৃতি ১০ দফা দাবি আদায়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে চাইলে যে কেউ অংশ নিতে পারে। জনআকাক্ষা পূরণে সংশ্লিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল- এ আন্দোলনের বাইরে থাকতে পারে না। বিএনপির দাবির মধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি রাজনৈতিক নেতা ও আলেম-ওলামাদের মুক্তির বিষয়টি রয়েছে।’

সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে মিছিল বের করতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এর জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী এবং ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় সহিংস ঘটনা ঘটে। তখন পুলিশ হেফাজতের পাশাপাশি বিএনপি নেতাকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করেছিল। 

২০২১ সালের ৩০ মার্চ  গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে হেফাজতি তাণ্ডবে বিএনপি ইন্ধন দিয়েছে, তাদের কর্মসূচি পালনে সমর্থন দিয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, হেফাজতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং হেফাজতকে উসকানি দিয়েছে, ইন্ধন জুগিয়েছে সরকার। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়।’              

এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজত নেতারা সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের কারাবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করতেই বিএনপির উল্টো পথে হাটছে। কিন্তু বিএনপি নেতারা যতই অস্বীকার করুক যে, হেফােজতের সাথে তাদের কোনো যোগসূত্র নেই। তবুও অতীত ইতহাসে দেখা যায়, হেফাজতে ইসলাম অতীতে বিএনপির সাথে যোগাযোগ করেই তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। হেফাজত রাজনৈতিক কোনো দল না হলেও মূলত বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। এখন হয়তো দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তির কারণে সরকারের সাথে সমঝোতা করার একটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কোন পথে হাটবে- তা বলা কঠিন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের মুক্তি হলে কি করবে হেফাজত? বা কোনো আইনী জটিলতায় যদি সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের মুক্তি না হয়, তাহলে কোন পথে হাটবে হেফাজত?



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭