ইনসাইড বাংলাদেশ

বেকারত্ব দূরীকরণে চমক দেখাচ্ছে নীলফামারী টিটিসি


প্রকাশ: 02/03/2023


Thumbnail

কারিগরি বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলছে নীলফামারী সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। এখানে কম্পিউটার, ইলেকট্রিক্যাল, ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ-বিদেশে চাকুরির সুযোগ পাচ্ছেন বেকার যুবক-যুবতীরা। এই টিটিসিতে বেকারত্ব দূরীকরণে অসাধারণ সফলতা অর্জন করেছে স্কিলস ফর ইমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ)। নীলফামারী টিটিসি থেকে শুধুমাত্র এই প্রকল্পের আওতায়ই মাত্র ১২মাসে ৭৫০ জন প্রশিক্ষণ নিয়ে এপর্যন্ত ৫১৬জন দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে চাকরি পেয়েছেন। পর্যায়ক্রমে বাকিরাও পাবে কর্মসংস্থান। শুধুমাত্র দক্ষ জনবল তৈরি করেই নয় বরং তাদের যোগ্য স্থানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে টিটিসি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মোঃ জিয়াউর রহমান।

জানা যায়, সেইপ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জ ইপিজেডের চেক পয়েন্ট সিস্টেম লিমিটেড, উত্তরা ইপিজেডের দেশবন্ধু, মার্জেন, আমিনুল ট্রেড, প্রাণ, আরএফএল সহ দেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন প্রশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি। শুধুমাত্র দেশেই নয়। দেশের গন্ডি পার হয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে পাঠাচ্ছে রেমিট্যান্স। দেশের দক্ষ জনশক্তি জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, গায়ানা, সৌদি আরব, কম্বোডিয়া সহ বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ হচ্ছে দেশের রেমিট্যান্স অর্থনীতি। এতে করে যেমন ধীরে ধীরে দেশের বেকারত্ব হার কমছে তেমনি নি¤œ ও স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোতে ফিরছে আর্থিক সচ্ছলতা। যার ফলে উন্নত হচ্ছে মানুষের জীবনমান।

নীলফামারী সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) সূত্র মতে,‘নীলফামারী টিটিসিতে গেল বছরের জানুয়ারি মাসে স্কিলস ফর ইমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ) প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। এক বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে এই প্রকল্পের আওতায় ৮টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ৭৫০জন। এরমধ্যে ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে ৫১৬ জন। সেইপ প্রকল্পের আওতায় এপর্যন্ত অটোক্যাড ট্রেডে ৮৮জনের মধ্যে ৫৪জন, আইটি সাপোর্ট (কম্পিউটার অপারেটর) ৮৬ জনের মধ্যে ৫৪জন, ইলেকট্রনিক্স ৯০জনের মধ্যে ৫৪জন, ইলেকট্রিক্যাল ৩০জনের মধ্যে ১৮জন, গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারিং ৮৩ জনের মধ্যে ৫৯জন, মেকানিক্যাল ৮৭ জনের মধ্যে ৫৬জন, হ্যাভি ইকুপম্যান্ট (ফ্রকলিপ,ক্রেইন,রোলার) ১৬৮ জনের মধ্যে ১২৯জন ও ড্রাইভিং ট্রেডে ১২০জনের মধ্যে ৯২ জন দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পেয়েছে কর্মসংস্থান।’

‘সেইপ প্রকল্পের ট্রেড ছাড়াও অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমেও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আর্কিটেকচার ড্রাফটিং, উইথ অটোক্যাড, ক¤িপউটার অপারেশন, গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারিং, ইলেকট্রিক্যাল হাউজওয়্যারিং, কনজুমার ইলেকট্রনিক্স, মেশিন টুলস অপারেশন, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন, মোটর ড্রাইভিং, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, হাউস কিপিং এবং বর্হিগমন ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বেকার যুবক-যুবতীরা। এছাড়াও জাপানী, কোরিয়ান, ইংরেজি এবং চাইনিজ ভাষা শেখানো হচ্ছে নীলফামারী টিটিসিতে।’

টিটিসি থেকে প্রশিক্ষন নেওয়া একাধিক প্রশিক্ষনার্থী জানান, ‘প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে প্রশিক্ষনার্থীরা পরিবারের বোঝা হয়ে থাকলেও প্রশিক্ষণের পর তারা চাকরি পেয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে পরিবারের জন্য আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রশিক্ষন নিয়ে খুজতে হয় নি তাদের কর্মসংস্থান। টিটিসি থেকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা করে  দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান। তারা বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।’

কম্পিউটার ট্রেডে প্রশিক্ষন নিয়ে নারায়নগঞ্জ ইপিজেডের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান চেক পয়েন্টে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি পাওয়া কাওসার আলী বলেন,‘নিজের কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কি করবো না করবো। পরে জানতে পারলাম টিটিসিতে বিভিন্ন ট্রেডে বিনামূল্যে প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে। তখন সেইপ প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার অপারেশন ট্রেডে চার মাসের কোর্সে ভর্তি হয়ে প্রশিক্ষন নিলাম। প্রশিক্ষন নেওয়ার পর টিটিসি আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দিবে তা ভাবতে পারি নি। আলহামদুলিল্লাহ এখন একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। ভালো বেতনও পাচ্ছি। দুশ্চিন্তাও দূর হয়েছে। এজন্য টিটিসিকে ধন্যবাদ জানাই।’

গার্মেন্টস ট্রেড থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের সেকশস-৭ এ সুপারভাইজার পদে চাকরি পেয়েছেন রিমা আক্তার। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। যার কারণে পড়াশোনা চালানো খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। কোনো কিছুতে দক্ষতাও ছিল না যে ওই বিষয়ে কোনো একটা চাকরি করবো। এক বন্ধুর মাধ্যমে খবর পাই বিভিন্ন ট্রেডে টিটিসিতে প্রশিক্ষন প্রদান করা হচ্ছে। তখন টিটিসিতে সেইপ প্রকল্পে গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারিং ট্রেডে চার মাসের প্রশিক্ষন কোর্সে ভর্তি হলাম। প্রশিক্ষন শেষ করে তখন চিন্তা আসলো চাকরি হবে কোথায়। এরপর হঠাৎ একদিন টিটিসি থেকে স্যার ফোন দিয়ে বললো সুপারভাইজার পদে চাকরি করবা। আমিতো অবাক হয়ে গেছি। যাই হোক আল্লাহর রহমতে আমি চাকরি পাওয়ায় পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে এজন্য টিটিসিকে ধন্যবাদ জানাই।’

ড্রাইভিং ট্রেডে প্রশিক্ষন নিয়ে দুবাইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন হাফিজ উদ্দিন। মুঠোফোনে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন,‘চার মাসের ড্রাইভিং প্রশিক্ষন নিয়ে এখন আমি বিদেশে প্রতি মাসে লাখ টাকারও বেশি উপার্জন করছি। বিদেশে আসার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু কেমনে, কিভাবে যাবো তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা ছিল। চারিদিকে দালালদের এত দৌরাত্ম ছিল বলার বাইরে। নীলফামারী টিটিসিতে মাত্র চার মাস ড্রাইভিং প্রশিক্ষন দিয়ে তারাই আমাকে দুবাই আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’

অটোক্যাড ট্রেডে প্রশিক্ষন নিয়ে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের মার্জেন কোম্পানীতে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি পাওয়া আতাউর রহমান বলেন,‘যখন বেকার ছিলাম তখন ভেবেছিলাম কি কাজ করবো। কিছুইতো পারি না। কিভাবে জীবন চলবে। কিন্তু টিটিসিতে প্রশিক্ষন নেওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমাদের কাজের জন্য কারো পিছনে দৌড়াতে হবে না। নিজেকে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুললে কাজই আমাদের কাছে দৌড় দিয়ে চলে আসবে। তাই আমাদের উচিৎ চাকরির পিছনে না ছুটে নিজেকে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তোলা। তাহলে অটোম্যাটিক সফলতা আমাদের কাছে চলে আসবে।’

অবকাঠামো, আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটের মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়নে কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকেরা দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে টিটিসিতে পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষন, হ্যাভি ইকুপম্যান্ট (ফ্রকলিপ,ক্রেইন,রোলার) সহ বেশ কিছু ট্রেডে প্রশিক্ষন দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। ড্রাইভিং প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায় টিটিসি থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রশিক্ষন দিতে হচ্ছে প্রশিক্ষনার্থীদের। এতে করে কিছুটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে প্রশিক্ষনার্থীরা। তবে ড্রাইভিং প্রশিক্ষন দূরে গিয়ে দেওয়া সম্ভব হলেও ক্রেইন অপারেটর ট্রেডে প্রশিক্ষন প্রদানে প্রশিক্ষকরা খাচ্ছে হিমশিম। টিটিসির ভিতরে পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায় বিশাল ক্রেইন চালনায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে প্রশিক্ষনার্থীরা।

জানতে চাইলে নীলফামারী সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এর অধ্যক্ষ মোঃ জিয়াউর রহমান বলেন, ‘২ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় টিটিসি। প্রতিষ্ঠানের ভিতরেই উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে একাডেমিক ভবন, আবাসিক হোস্টেল ও অধ্যক্ষের বাসভবন রয়েছে। শুরুতে এখানে পাঁচটি  ট্রেডে প্রশিক্ষন শুরু হলেও এখন ১৩টি ট্রেডে প্রশিক্ষন প্রদান কার্যক্রম চলছে। পর্যায়ক্রমে ট্রেডের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যায়গা সংকুলানের কারণে কিছু কিছু ট্রেডের প্রশিক্ষন প্রদানে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে।’

স্বল্প শিক্ষিত কিংবা বেকাররা সমাজের বোঝা নয়, তাদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলে মানব সম্পদে পরিণত করাই আমাদের লক্ষ্য বলে জানিয়ে অধ্যক্ষ জিয়াউর রহমান আরও বলেন,‘বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে টিটিসি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য শ্রমবাজারে চাহিদার ভিত্তিতে যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করে তাদের লক্ষ্যে পৌছে দেওয়া। এছাড়াও প্রশিক্ষিত মানুষকে বিদেশগামী করতে ও দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে টিটিসি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে টিটিসি। দেশের প্রশিক্ষিত নাগরিকগণ বিদেশে ভালো কাজের নিশ্চিয়তা পেয়েছেন। এতে করে কমছে বেকারত্ব, পরিবারে ফিরছে স্বচ্ছলতা। আশঙ্কাজনক হারে কমেছে দালালদের দৌরাত্ম্য, স্বস্তিতে বিদেশে গমণ করতে পারছেন দক্ষ জনসম্পদ।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭