ইনসাইড আর্টিকেল

‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’: শেখ মুজিবের শাসন শুরু, বদলে যায় বেতার-টেলিভিশনের নাম - ৪ মার্চ ১৯৭১


প্রকাশ: 04/03/2023


Thumbnail

৪ মার্চ ১৯৭১। একাত্তরের মার্চে দিন যত গড়াচ্ছিল, ততই তীব্র হচ্ছিল বাঙালির বিক্ষোভ-দ্রোহ। উত্তাল মার্চের এই দিনটির ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাঙালির জাতির ব্যাপক প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায় । যে প্রস্তুতির সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কার্যত ৪ মার্চ পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো নয়, চলছিল শেখ মুজিবের শাসন।

এদিন এক বিবৃতিতে বঙ্গবনন্ধু মেক মুজিব বলেন, ‘হরতালের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যে সব কর্মচারী বেতন পাননি তাদের সুবিধার্থে প্রতিদিন দু’ ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খোলা থাকবে। বাংলাদেশের জন্য অনধিক পনের শ’ টাকা পরিমাণ বেতনের চেকই কেবল ক্যাশ করা যাবে। স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলাদেশের বাইরে কোনো টাকা পাঠানো যাবে না।’

অন্যদিকে বেতার-টেলিভিশন-চলচ্চিত্রা শিল্পীরা এক বিবৃবিতে ঘোষণা করেন, ‘যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত ‘বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না।’

সে সময়ে ওই বিবৃবিতে সই করেন, লায়লা আর্জুমান্দ বেগম, আফসারী খানম, আতীকুল ইসলাম, ফেরদৌসী রহমান, মুস্তফা জামান আব্বাসী, গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, জাহেদুর রহিম, আলতাফ মাহমুদ, ওয়াহিদুল হক, এএম হামিদসহ আরও কয়েকজন। পরে লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিনে ৪ মার্চ রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে।

মার্চ মাস বিশ্বের ভূখন্ডে নতুন একটি মানচিত্র তৈরির মাস। বিশ্ব ভুখণ্ডে সৃষ্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের মাস- উত্তাল এই মার্চ মাস। বাংলাদেশের জন্ম হয় এই উত্তাল মার্চেই। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র চতুর্থ পর্বে থাকছে ৪ঠা মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।

জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকাসহ সারা বাংলায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল চলে। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে।

পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন এ দিন তাদের এক জরুরি সভায় বাংলার জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। ওই সভায় ৬ মার্চ সাংবাদিকদের মিছিল এবং বায়তুল মোকাররমে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোনো জাতির মুক্তি আসেনি।’ এ সময় তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানে সাড়া দেওয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান।

৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি, শুধু বেতন দেওয়ার জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।’

এদিকে করাচি প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার দাবি জানান প্রেসিডেন্টের কাছে।

পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক বিবৃতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। (সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র)।

শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আহূত প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী, পুরুষ, শিশু তেজদীপ্ত সাড়া দেওয়ায় জনতাকে অভিনন্দন জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসামরিক, নিরস্ত্র শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র-জনতা বুলেটের সামনে যে সাহস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে লক্ষণীয়। তাই বাংলার সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

পৃথক এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মাওলানা ভাসানী বলেন, ‘ওরা সাম্রাজ্যবাদের দালাল। ওদের শোষণ-নির্যাতনে ৮৫ ভাগ বাঙালি আজ প্রায় মৃত্যুর সম্মুখীন। সুতরাং যে ব্যক্তি, যে রাজনৈতিক দল অথবা যে রাজনৈতিক নেতা পশ্চিমাদের সাথে কিংবা সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কোনো রকমের আঁতাত করবে বা করতে যাবে সে যে শুধু তার নিজস্ব ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হবে, তা নয়, বরং তার জানমালও বিপন্ন হবে।

বিবৃতিতে দেশের সকল সম্প্রদায় যেমন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বাঙালি বা অবাঙালি সবার মধ্যে সহযোগিতা ও পূর্ণ শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান মওলানা ভাসানী।

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনসভা আয়োজন করে। সেখানে সংগঠনের সভাপতি নুরুল ইসলাম ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘দেশে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতিগত অধিকার তথা বাংলার স্বাধিকারের সংগ্রামকে বানচাল করার অপচেষ্টা রুখে দাঁড়াতে হবে।’

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভানেত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। বাংলার স্বাধিকারের সংগ্রামকে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। আর এই জন্যই পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গঞ্জে সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র জনতাকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায় পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন। ইউনিয়নের সভাপতি আলী আশরাফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, ‘মার্চের গণআন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের হত্যার বিচারের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে এবং হতাহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ওপর যে সব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় ৪ মার্চের সভায়। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, ‘স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার না দিলে সাংবাদিকরা বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।’ পরে বেতার এবং টেলিভিশনের নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করা হয়।

এ রকম পরিস্থিতিতে ভুট্টো বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার ফলে আওয়ামী লীগ যে চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে- তা আশা করা যায় না। আওয়ামী লীগের সাথে ৬ দফা প্রশ্নে আলাপ-আলোচনার জন্য শুধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্বল্প সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণার দাবি করেছিলাম মাত্র।’

কিন্তু ভুট্টোর এই মন ভোলানো কথায় মন গলেনি বীর বাঙালির। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারাদেশে পালিত হয় স্বত:স্ফূর্ত হরতাল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে প্রতিদিন ভোর ৬ টা থেকে দুপুর ২ টা হরতাল পালনের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে বাঙালি জাতি। (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র)।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭