প্রকাশ: 05/03/2023
৫ মার্চ ১৯৭১। স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির সর্বাত্মক সংগ্রামের পঞ্চম দিনেও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। টঙ্গীতে
শ্রমিক-জনতার মিছিলে চালানো গুলিতে সেদিন চার ব্যক্তি নিহত,
১৪ জন আহত হন।
গুলিবর্ষণে আহত হলে ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার
পথে মারা যান রফিজ
উদ্দিন (৩৫)। আহত
আব্দুল মতিনও মারা যান ঢামেক-এ। ১৯৭১
সালের প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে ১৯৭২
সালে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তৎকালীন দৈনিক বাংলা পত্রিকা। এছাড়াও দৈনিক ইত্তিফাক ও দৈনিক আজাদ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংবাদ প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে
স্বাধীনতার ইতিহাসে মার্চ মাস বিশ্বের ভূখন্ডে
নতুন একটি মানচিত্র তৈরির
মাস। বিশ্ব ভূখণ্ডে সৃষ্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের মাস-
উত্তাল এই মার্চ মাস।
বাংলাদেশের জন্ম হয় এই
উত্তাল মার্চেই। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র পঞ্চম পর্বে
থাকছে ৫ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।
একাত্তর
সালের ৫ মার্চ দৈনিক
ইত্তেফাকের ব্যানার হেডলাইন ছিল- ‘জয় বাংলার’ জয়।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার ‘ক্রেডিট লাইন’ দিয়ে সেদিন ওই
প্রতিবেদনের শুরুর দিকের একটি লাইন ছিল-
“ক্ষমতার দুর্গ নয়, জনগণই যে
দেশের সত্যিকার শক্তির উৎস, বাংলাদেশের বিগত
তিন দিনের ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে সপ্রমাণিত হয়েছে।”
১৯৭১
সালের মার্চের প্রতিটি দিনই ছিল উত্তাল।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলার
মানুষের দুর্জয় আন্দোলন দেখে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে
(পশ্চিম পাকিস্তান) নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে।” ওই
দিন ইত্তেফাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। আগের দিনের
ওই বিবৃতির খবরের শিরোনাম ছিল, ‘সংগ্রামী জনতার প্রতি নেতার অভিনন্দন।’
১৯৭১
সালের ৫ মার্চ প্রকাশিত
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘জয় বাংলার’ জয়।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার নামে সম্পাদকীয়র আদলে
মূল খবরটি উপস্থাপন করা হয়েছিল। আগের
তিন দিনের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ‘অস্ত্রের ভাষার’ মোকাবিলায় স্বাধিকারকামী নিরস্ত্র জনগণের সংগ্রামকে জয়যুক্ত হিসেবে দেখেছে দৈনিক ইত্তেফাক। পরদিন ৬ মার্চ পাকিস্তানের
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঢাকায় আসার গুঞ্জনের তথ্য
উল্লেখ করা হয় খবরটিতে।
জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
ডাকা কর্মসূচির দুই দিন না
যেতেই শহর থেকে সান্ধ্য
আইন প্রত্যাহার করা হয়। ৩
মার্চ ক্ষেত্রবিশেষে গুলি চললেও আগের
দিন (৪ মার্চ) দিনে
ও রাতে সামরিক প্রহরীদের
আনাগোনা ছিল না বলেও
জানানো হয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারের
তথ্যে।
১৯৭১
সালের ৪ মার্চ সংগ্রামী
জনতার প্রতি অভিনন্দন
জানিয়ে বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু। ৫
মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এ নিয়ে একটি
খবর প্রকাশিত হয়। শোষণ ও
উপনিবেশবাদী শাসন অব্যাহত রাখার
ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানে
সাড়া দেওয়ায় বীর জনতাকে অভিনন্দন
জানান তিনি। আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন,
‘বিশ্ববাসী দেখে রাখুক.বাংলাদেশের
নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বুলেটের মুখেও
কী দুর্দান্ত সাহস ও দৃঢ়তার
সঙ্গে তাদের অধিকার হরণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।’
শেখ
মুজিব বিবৃতিতে মনে করিয়ে দেন,
‘চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনোদিন কোনো
জাতির মুক্তি অর্জিত হয়নি। জনগণকে তাই যেকোনো মূল্যে
স্বাধিকার আদায়কল্পে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে
হবে।’
দৈনিক
ইত্তেফাকের ৫ মার্চের প্রথম
পাতায় ওপরের দিকে রাখা একটি
খবরের শিরোনাম ছিল, ‘অবিলম্বে আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর
করুন’। করাচি প্রেসক্লাবে
৪ মার্চ এই দাবি জানান
এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান।
‘গোলটেবিলে
নয়, জাতীয় পরিষদে’ শিরোনামে আরেকটি খবর ছিল ইত্তেফাকের
৫ মার্চের প্রথম পাতায়। পিপিপি প্রধান নুরুল আমিন শিগগিরই জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানান। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের ডাকা ১০ মার্চের
নেতৃসম্মেলন যোগদানের আমন্ত্রণ এক বিবৃতির মাধ্যমে
প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
ইত্তেফাকের
৫ মার্চের প্রথম পাতায় নিচের অংশের বাঁ-দিকে প্রকাশিত
একটি খবরে জানানো হয়,
বেতার, টিভি ও চলচ্চিত্রের
২০ জন বিশিষ্ট শিল্পী
সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বেতার-টেলিভিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যতদিন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং জনগণ ও
ছাত্র-সমাজ সংগ্রাম করবে
ততদিন তারা বেতার-টেলিভিশনের
অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না।
জাতীয়
পরিষদের অধিবেশ স্থগিত রাখার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকা কর্মসূচিতে আগের
দুই দিন অগ্নিসংযোগ, গোলাগুলি
ও সংঘর্ষসহ চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২২।
এছাড়া খুলনায় ৬ জন নিহতসহ
৩৩ জন হতাহতের ঘটনা
ঘটে। ৫ মার্চের ইত্তেফাকের
প্রথম পাতায় এই তথ্য জানানো
হয় একটি খবরের শিরোনামে।
এ কারণে ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিতে আবেদন
জানান শেখ মুজিব। ইত্তেফাকের
প্রথম পাতার নিচের অংশে ডান দিকে
এই খবর ছাপা হয়।
প্রথম
পাতার অন্যান্য খবরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ঢাকায় কারফিউ
প্রত্যাহার, ভাইস অ্যাডমিরাল আহসানের
ঢাকা ত্যাগ, ১১৩ নং সামরিক
আইন আদেশ জারি, ঢাকা
বেতার থেকে আরও দুইবার
স্থানীয় সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে স্বাধিকার আন্দোলনের সময়সূচি।
জনতার
ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে একাত্তরের এই দিনে দেশব্যাপী
সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। মুক্তিকামী বাঙালির
উত্তাল ও অপ্রতিরোধ্য দুর্বার
আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে ওঠে।
নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ থেকে
শুরু করে সব ধরনের
অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে, দ্বিগুণ গতিতে গর্জে ওঠে বাংলার প্রতিবাদী
মানুষ। ঐতিহাসিক মার্চের এই দিনে ঘটে
আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণাকে অবাঞ্ছিত
ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করে বেলুচিস্তান ন্যাপ।
৫ মার্চ ১৯৭১। ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়,
টঙ্গীতে গুলিবর্ষণে ৪ জন নিহত
২৫ জন আহত হয়।
চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮ (পরে আরও
বেড়েছিল)। রাজশাহী-রংপুরে
আবার কারফিউ। এই দিনে ভুট্টোর
সঙ্গে ইয়াহিয়ার ৫ ঘণ্টা বৈঠক
হয়। গভীর রাতে পাওয়া
এক খবরে জানা যায়,
জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে পাঁচ ঘণ্টা
টানা বৈঠক করেন।
রাতে
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে
বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেটসহ বাংলাদেশের
অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের
হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে
নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে
অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭