ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধু- জানুয়ারী থেকে মার্চের জয়রথে


প্রকাশ: 05/03/2023


Thumbnail

[পর্ব-১]

সত্তুর সালে পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়েও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা চলছিল ভুট্টো ও পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সম্মিলিত কূটচালে। এই সময়ে বাঙালীর আশা আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এক পরিণত নেতৃত্ব শক্তিতে আবির্ভূত হন। আজকের দিনে সেসব তথ্য ও ঘটনাবলীর স্বাক্ষ্য প্রমাণাদি পর্যালোচনা করলে অবিশ্বাস্য নেতৃত্বের আধিকারী বঙ্গবন্ধুর যে পরিচয় আমরা পাই, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমন শক্তিধর নেতার আর দ্বিতীয় কোন উদাহরণ নেই যিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি দেশের সম্পুর্ণ নেতৃত্ব করায়ত্ত করে নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চের মধ্যেই এই শক্তিধর মানুষটির পরিচয় পেয়েছিল পাকিস্তান সরকার থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবী, এমনকি সুদূর মার্কিন মুল্লুকের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতি নির্ধারক পাকিস্তান-গুরু হেনরী কিসিঞ্জারও।

১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসের ৩ তারিখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রেসকোর্স ময়দানে একটি বিরল ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত ১৫১ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং ২৬৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের সংকল্প ঘোষণা করে শপথ গ্রহণ করেন। ৪ জানুয়ারী তারিখের ইত্তেফাক পত্রিকা এই তথ্য জানিয়ে লিখেছে, “সম্ভবতঃ পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই ধরণের গণশপথ গ্রহণ এই প্রথম”। ইত্তেফাক পত্রিকা আরও লিখেছে, “শেখ মুজিবের ডানপার্শ্বে জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ এবং বাম পার্শ্বে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ দাড়াইয়া শপথ গ্রহণ করেন। প্রত্যেকের বাম হাতে শপথনামা এবং ডান হাত শপথের ভঙ্গীতে উদিত ছিল। নেতার সঙ্গে সঙ্গে সকল সদস্য শপথনামা পাঠ করেন। শপথ পাঠ করার পূর্বে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের সামনে জনসাধারণকে স্বাক্ষী রাখিয়া শপথ গ্রহণ করিতেছেন। শপথ গ্রহণ শেষ হইলে বিশাল জনতা উল্লাসে ফাটিয়া পড়ে”।

বঙ্গবন্ধুর এই দৃঢ় নেতৃত্বগুণই তাঁকে মার্চের অবশ্যম্ভাবী রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় পৌঁছে দিয়েছিল। বিশেষ করে নভেম্বর নির্বাচনের পরে কুচক্র পাকিস্তানী নেতাদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ও ক্ষমতা হস্তান্তরের তালবাহানার কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু পরিমিতিবোধে অনবদ্য এক ধৈর্যশীল ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বের পরিচয় দেন। উপরোল্লিখিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সেসবের অন্যতম উদাহরণ।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ১৯৭০-৭১ সালে এক শ্রেণীর সন্ত্রাসী তথাকথিত বাম রাজনীতিক দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল, যে কারণে একই সাথে পাকিস্তানী চক্র এই অপরাজনীতির প্রভাবের কথা সুকৌশলে প্রচার করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীকার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ খুঁজছিল। ৩ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করেন যা ৪ তারিখের ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “ইউনিয়নে ইউনিয়নে, মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগ গঠন করুন এবং রাতের অন্ধকারে যারা ছোরা মারে তাদের খতম করার জন্যে প্রস্তুত হোন। রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, সেইসব বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চোরের মত রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করিয়া বিপ্লব হয়না। বিপ্লব চোরের কাজ নয়”। ইত্তেফাক আরও লিখেছে, “সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের দালালদের খতম করার জন্যে প্রত্যেক নাগরিককে বাঁশের এবং সুন্দরী কাঠের লাঠি বানাইবার পরামর্শ দিয়া শেখ সাহেব বলেন, প্রত্যেকের হাতে আমি হয় বাঁশের নয় সুন্দরী কাঠের লাঠি দেখিতে চাই। কিন্তু খবরদার আমার হুকুম ছাড়া সেগুলি ব্যবহার করবেন না”।

জানুয়ারী থেকে মার্চের সময়কালের পত্র-পত্রিকাগুলোয় অনুসন্ধান করলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু খুবই পরিশীলিত ধাপে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাবার কাজ করছেন। একই সময় পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো নানারকম কূট কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন, পত্র-পত্রিকায় মন্তব্য-বিবৃতি পাঠাচ্ছেন যাতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা আওয়ামী লীগ ও তার অসিংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের কাছে কোনভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয়। ভূট্টোর এসব উস্কানীমূলক বক্তৃতা–বিবৃতির জবাবে বঙ্গবন্ধু ধীরস্থির, পরিণত ও শক্ত অবস্থান জানান দিয়ে পাল্টা বক্তব্য দিতেন। এরকম একটি বক্তব্য জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিসমূহের যৌথ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু দেন যার সারাংশ ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয় ১৬ ফেব্রুয়ারী- “জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার উদ্দেশ্যে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীদের প্রতি আগুন লইয়া খেলা হইতে বিরত থাকার জন্য তিনি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, আমার ও ৬-দফার মোকাবিলার জন্য সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করার চক্রান্ত চলছে...সাতকোটি বাঙ্গালীর বুকের উপর মেশিনগান বসিয়েও কেহ ঠেকাতে পারবে না”। ১৮ ফেব্রুয়ারী মর্নিং নিউজ পত্রিকাও বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য প্রচার করে যার সংবাদ শিরোনাম ছিল, “বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনকে কোন শক্তিই থামাতে পারবে না বলে শেখ মুজিবের ঘোষণা”।

একই সময়কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো ৬-দফা ও স্বায়ত্তশাসন দেয়া-নেয়া নিয়ে নানারকম বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করছিল। গ্রহণযোগ্য প্রায় সকল যুক্তিই বঙ্গবন্ধু আমলে নেন ও তার বক্তব্যের মাধ্যমে সেগুলো স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেন। ফলে বাঙ্গালীর মুক্তির যে অভীষ্ট লক্ষ্য অনিবার্যভাবেই একটি সম্মিলিত ও সমন্বিত আয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য অর্জনের দিকে ধাবিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ২৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে কমিউনিস্ট পার্টির কিছু প্রস্তাব আলোচনায় আসে যেখানে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পার্টি সুস্পষ্টভাবে এই মর্মে উপসংহারে আসে যে, “এই সংগ্রাম স্বাধীন জাতীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সন্মুখে রাখিয়া আমাদের প্রচেষ্টা হইবে এই সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির তথা দেশি-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে পরিচালিত করা”।

এরকম নানা মত ও পরামর্শ, ভুট্টোর উদ্বেগ, অপপ্রচার ও হুমকীর জবাব দেন বঙ্গবন্ধু ২৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সম্বর্ধনা সভায় যার বিস্তারিত ছাপা হয় পরদিন ১ মার্চ তারিখে ইংরেজী ডন পত্রিকায়। চলমান সংগ্রামের মাধ্যমে ছয় দফা কর্মসূচী অর্জনের লক্ষ্যে তিনি বিশদ বিশ্লেষণ করে এই অনুষ্ঠানে একটি দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। ইতিপূর্বে ভুট্টোর দেয়া বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীকার আন্দোলনকে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে ব্যাঙ্গ করার প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, “যারা এসব কথা বলে তারা আসলে সঙ্খ্যালগিষ্ঠের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এসব মন্তব্য শুধু আপত্তিকরই নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যেও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে”। বঙ্গবন্ধু সতর্ক করে বলেন, “যারা আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে বাধা সৃষ্টি করছে ও গতন্ত্রের জন্যে হুমকি হয় এমন কাজ করছেন তার ফলাফল এমন কিছু হতে পারে যার জন্যে আমরা দায়ী থাকবো না”। এই আলোচনায় তিনি তাঁর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির চিন্তা বিশ্লেষণ করে নতুন সরকারের জন্যে তাঁর এই অর্থনৈতিক দর্শনকে কোন বিপ্লবের মাধ্যমে নয় ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে বা ধাপে ধাপে সে পর্যায়ে উন্নীত করার স্বপ্ন ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি হবে জনকেন্দ্রিক, যাতে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার পায়”। একই আলোচনায় তিনি ২৩ বছরের পাকিস্তানী নিষ্পেষণের বিবরণ দিয়ে বলেন, “এই ২৩টি বছর গেছে আমাদের প্রতারণা, হতাশা ও দুঃখের মধ্যে। আমরা এই নিস্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে ও বাংলাদেশের মানুষকে একটি ভালো জীবন উপহার দিতে আমাদের সংগ্রাম আব্যাহত রেখেছি”। এই ভাষণের শেষের দিকে এসে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের একটি অনুপম ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “এই শ্লোগান কোন রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, এই শ্লোগান বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির শ্লোগান। এই শ্লোগান আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার ও সাংস্কৃতিক মুক্তির শ্লোগান”।

আমাদের প্রাক মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত মহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হয় ৭ই মার্চ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে বাঙালী জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু জানুয়ারী ১৯৭১ থেকে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক সভার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ৭০ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা না দিতে যেসব হঠকারী কাজকর্ম পাকিস্তান সরকার ও ভুট্টো মিলে করেছে তাতে বঙ্গবন্ধু অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ বক্তব্য, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হঠকারী ভুট্টোর পক্ষে হজম করা কঠিন ছিল যে কারণে তাদের ক্ষমতার মোহ, ক্ষোভ ও ব্যাক্তিগত পরাজয়ের অস্থিরতা মিলে পুরো বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করার প্রবৃত্তির জন্ম দেয়। লোপ পায় মানবিকতা। তাদের জিঘাংসার কাছে বলী হতে হয় ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালীর জীবন ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম। কিন্তু ইতিহাস তাদের পরাজিত করে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।

যেসব তথ্যাদি এখন পাওয়া যায় সেগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণার সুযোগ আছে। যারা আগ্রহী বিশেহ করে তরুণ সমাজ তাদের অবশ্যই টেবিল ঘুরিয়ে বসতে হবে। এই বাংলাদেশটা এমনি এমনি হয়নি বা “কারও দানে পাওয়া নয়”। এই বাংলাদেশ এমনই এক দেশ যে দেশে শেখ মুজিবর রহমান নামে এক পরাক্রমশালী ব্যাক্তিত্বের জন্ম হয়েছে নিতান্তই এক অজ পাড়া গাঁয়ে যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র নেতা- শুধুমাত্র সংগ্রামের জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন একটি দেশের মানুষকে স্বাধীনতার আনন্দ এনে দিতে।                               


রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প

ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭