ইনসাইড থট

শিক্ষামন্ত্রী, কচ ও নৈতিকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/02/2018


Thumbnail

শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন খবর বিভিন্ন পত্রিকায় যাচ্ছে। কথাটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগা থেকেই আমার এই লেখা। মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কেউ অযৌক্তিক খারাপ কথা বললে আমার কষ্ট হয়, রাজাকার, বা রাজাকার মানসিকতার রাজনীতিবিদ ছাড়া অন্য কোনো রাজনীতিকদের অন্যায়ভাবে দোষারোপ করলে আমার কষ্ট লাগে।

পরীক্ষার প্রশ্ন আউট হচ্ছে হর হামেশা। শিক্ষামন্ত্রী ঠেকাতে পারছেন না পরীক্ষার প্রশ্ন আউট, এটাই তার ব্যর্থতা। কী চমৎকার একপেশে কথা? একজন ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানের মন্ত্রী হতে কত বছর লাগে? কত বছর তাঁকে রাজনীতির প্র্যাক্টিক্যাল পাঠ নিতে ও বাস্তবিক প্রয়োগ করতে হয়? একজন ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট হতে যা সময় লাগে তার ছেয়ে ঢের বেশী কর্মঘন্টা ব্যয় করতে হয় ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানকে। তাঁর কোনো ছুটির দিন নেই, নেই কোনো অফিস টাইম। ২৮ ঘণ্টাই অফিস, জনতার জন্য। ‘পারবো না‘ শব্দটি ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানের জীবনের ডিকশনারি থেকে মুছে ফেলতে হয়।তাঁকে হতে হয় ‘সকল কাজের কাজি’। ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট সপ্তাহে সাকুল্যে ৫ দিন ৯-৫টা অফিস করে আইনের মধ্যে থেকে কাজ করেন, আইনে না থাকলে বলেন ‘হবে না’। সেখানেই তাঁর দায়িত্ব শেষ। ৫টা বাজার পরে কেউ এলে বলতে পারেন করব না, অফিস টাইম শেষ। কিন্তু মন্ত্রী বা রাজনীতিক তা পারেন না। দরকার হলে তাঁকে আইন বদলাতে হয়, মানুষের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে। সেই বিচারে কোন দেশের উন্নয়নে একজন ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট থেকে একজন ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানের অবদান অনেক বেশি। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের অবস্থা রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কাব্যের নায়ক ‘কচ’ এর মতো। দেবযানীর অভিশাপের পরে যিনি ‘মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা’ অন্যকে শেখাতে পারতেন কিন্তু নিজে প্রয়োগ করতে পারতেন না।রাজনিতিকগন আইন প্রণয়ন করেন কিন্তু প্রয়োগ করেন আমালাগন। তবুও সব বদনাম রাজনীতিকদের।

যা হোক, মিডিয়ার খবরের সূত্রে জানা যায় যে আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি ও বিলি করতে সর্বমোট ৩০হাজার মানুষ সম্পৃক্ত। যাদের নিয়ন্ত্রণের ভার বাস্তবে আমলাদের উপর, মন্ত্রীর উপর থাকে কাগজে কলমে, মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে। তাঁর পরেও ওই ৩০হাজার মানুষ সবাই মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দপ্তরের কী? না, একদম সত্যি না। তবে কেন তাঁর ঘাড়ে সব দায় এসে পড়ে! সেখানেই তো শুভংকরের ফাঁকি। আমার সরকারি চাকুরে এক বন্ধু বললেন, সরকারি কর্মীরা তাঁর কথা শুনবেন, যারা তাঁর এসিআর লেখেন, অন্যাদের কথা শুনার ভান করেন মাত্র। আইনে নাকি এমন ফাঁক আছে যে, সচিব বা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মন্ত্রীর কথা না শুনলে বদলি বা খুব বেশি হলে কয়েক মাসের ওএসডি। কিন্তু ওই ফাঁকে মন্ত্রীর বারটা বেজে সারা।

যা হোক এবার আসি পরীক্ষা নেবার কৌশল নিয়ে কথায়। আমি ২০১৫ সালে আমার ফেসবুকের একটা পোস্টে একবার বলেছিলাম (Sayedul Arefin October 4, 2015, Dhaka; মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস ও একটি প্রস্তাব)ওপেন বুক এক্সাম এর কথা। সেটাই একটু বিস্তারিত বলি।

ওপেন বুক এক্সামএর ক্ষেত্রে যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করা হয় প্রায় ৫/৬ সেট। সে সব সেটের প্রশ্নের মধ্যে কমন থাকে খুব কম সংখ্যক প্রশ্ন যা আউট হলেও সাধারণ পরীক্ষার্থীর পক্ষে কোন মতে পাশ মার্ক তোলা সম্ভব। প্রশ্নগুলো এমনভাবেই করা হয় যাতে চ্যাপ্টার ধরে ধরে পুরো সিলেবাস পুরোপুরি না পড়লে সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। হালের আইটি যুগে পরীক্ষা হলের বোর্ডে প্রশ্ন ডিসপ্লে করা হতে পারে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বা হলের মধ্যে ছাপানো প্রশ্নও বিলি করা যায়। সেক্ষেত্রে মন্ত্রী মহোদয় পছন্দ করবেন কোন সেটে পরীক্ষা হবে। আগেই বলেছি যে, প্রশ্নগুলো এমনভাবেই করা হয় যাতে করে পুরো সিলেবাস না পড়লে কেউ পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারবে না। বই খুলে পরীক্ষা দিলেও পাশ মার্কস তোলা কঠিন হয়ে যাবে। এসএসসি বা এইচএসসি বা ডিগ্রী ক্লাসে অনেক সময় অসুস্থ পরীক্ষার্থীরা বাসায় বসেও পরীক্ষা দিতে পারেন। কী ভাবে তা সম্ভব! যারা বাসায় বসে পরীক্ষা দেন তাঁদের আংগুলের ছাপের পাসওয়ার্ড দিয়ে অনলাইনে কম্পিউটার বা ল্যাপটপে পরীক্ষার সফটওয়্যারে লগ ইন করে পরীক্ষা দিতে পারেন ক্যামেরাওয়ালা কম্পিউটার বা ল্যাপ্টপের সামনে বসে, যা মেইন সার্ভারে সব রেকর্ড হয়ে যায়। অন্য কেউ পাশ থেকে সাহায্য করছেন কী না তাও ধরা পড়ে যাবে। পরীক্ষা শুরুর সময় আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে পরীক্ষার ওয়েব সাইটে ঢুকে পরীক্ষা দিতে হয়, কে পরীক্ষা দিচ্ছে তাঁর ছবিও দেখা যায়।পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হলে পরীক্ষার্থী আপনা আপনি লগ আউট হয়ে যাবে। উন্নত বহু দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে, খোঁজ নিলেই জানা যাবে। এমন কী সব প্রশ্ন আগে আউট হলেও না পড়াশুনা করে সব উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় কোন ছাত্রের পক্ষে কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক কিন্তু তা পারবেন। এখানেই আসে নৈতিকতার প্রশ্ন।

বাংলাদেশে চলমান পাবলিক পরীক্ষায় ধর্ম ও নৈতিকতার প্রশ্নটিও নাকি আউট হয়ে গেছে এবার। তাই সরকারের উপর মহল থেকে যেমন প্রশ্ন আউট হওয়া ঠেকাতে কাজ করতে হবে, ঠিক একই সময়ে নীচের লেভেল থেকেও নৈতিকতার শিক্ষা বা পাঠদান জোরদার করতে হবে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে দিতে হবে নৈতিক শিক্ষা। নৈতিকতা থাকবে পাঠ্যক্রম তৈরিতে, শিক্ষকের পাঠদানে, পঠনে। এর জন্য লাগবে পারিবারিক নৈতিকতার শিক্ষা শিশুদের মাধ্যমে। শিশুরাই শেখাবে নৈতিকতা তাঁদের বাবা -মা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজনদের। এটা হতে হবে একই সাথে টপ ডাউঁন আর বটম আপ এপ্রোচ।শিক্ষা নীতিতেও যেমন থাকতে হবে নৈতিকতার প্রতিফলন। তাৎক্ষণিক ফল না এলেও অদুর ভবিস্যৎ এ ভালো ফল আস্তেই হবে। কারণ এই নৈতিকতার শিক্ষা চলবে শিক্ষার উচ্চ স্তরেও, সেখানে পেশাগত নৈতিকতার শিক্ষাও দিতে হবে। এভাবেই সমাজের প্রতিটি স্তরে নৈতিকতা আসবে প্রতিষ্ঠিত হবে নৈতিক রাষ্ট্র। তখন আর বাবা -মা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজনদের কেউ প্রশ্ন আউট করার জন্য যাবেন না।

সব দেশেই আইন অপরাধের পিছু পিছু চলে। তাই আইন দিয়ে অপরাধ সাময়িকভাবে কিছুটা দমন করা গেলেও একেবারে নির্মূল করা যায় না। অপরাধ নির্মূলের কাছাকাছি আনতে চাই নৈতিক মূল্যবোধে জারিত একটি উন্নত জাতি গোষ্ঠী। যা একটা অপরাধমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে অপরিহার্য। আর্থিকভাবে, শিক্ষায় ও নৈতিকতায় উন্নত বাংলাদেশের কথা ই তো আমরা স্বপ্ন দেখি। এভাবেই আমরা ফিরে যেতে পারি একটা উন্নত মডেলের দেশে, সেই প্রাচীন কালের মত, যখন ইউরপিয়ানরা আমাদের কাছে আসতেন উন্নত জীবনের শিক্ষা নিতে। তাই ব্লেইম গেম না খেলে মনে হয় সবাই একটু দায়িত্বশীল হলে সেই সুদিন যে আসবে তা আর বেশী দূরে নয়।

সায়েদুল আরেফিন

উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

E-mail: arefinbhai59@gmail.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭