ইনসাইড আর্টিকেল

‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’: অধিবেশন ডেকে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ- ৬ মার্চ ১৯৭১


প্রকাশ: 06/03/2023


Thumbnail

৬ মার্চ ১৯৭১। দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ঢাকায় ২৫ মার্চ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। তিনি এতদিনের আন্দোলনকে গুটিকয়েক ব্যক্তির কাজ বলে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্য জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঢাকার রাজপথ এদিন স্বাধীনতাকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। উত্তেজিত জনতা চিৎকার করে বলতে থাকে ‘রক্ত চাও নেবে - তবু স্বাধিকার দিতেই হব ’।

সারাদিন অর্থাৎ সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল ছিল। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি হলো। সশস্ত্র-বাহিনীর ট্রাক আর অ্যাম্বুলেন্স ঘন ঘন যাতায়াত করছিল। কিন্তু বন্ধ ছিলো না মুক্তিকামী বাঙালির মিছিল, মিটিং, সংগ্রাম, আন্দোলন।

স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস। দেশটির স্বাধীনতার ইতিহাসে মার্চ মাস বিশ্বের ভূখণ্ডে নতুন একটি মানচিত্র তৈরির মাস। বিশ্ব ভূখণ্ডে নবসৃষ্ট বাংলাদেশের ইতিহাস পরিবর্তনের মাস- উত্তাল এই মার্চ মাস। বাংলাদেশের জন্ম হয় এই উত্তাল মার্চেই। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র ষষ্ঠ পর্বে থাকছে ৬ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।

সেদিন স্লোগান উঠেছিলো ‘জয় সর্বহারার জয়, জয় বিদ্রোহী বাংলার জয়, জয় নিপীড়িত মানুষের জয়’। একটি স্লোগান সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতে থাকলো ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো - বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। পহেলা মার্চের পর থেকে গুলিবিদ্ধ লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর আর ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবী ঘোষণা করার পর থেকেই শহর-বন্দর আর গ্রামে গ্রামে বিক্ষোভ-জনসভা চলতে থাকে। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চায়। 

শত শত মানুষ নিহত হওয়ার পর, মিছিল, মিটিং, কারফিউ ভঙ্গ, প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের পর ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান কি ঘোষণা দেন; তা জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে রইল মুক্তিকামী বাঙালি। একাত্তরের মার্চের শুরুতে সারাদেশ তখন সভা-সমাবেশ-মিছিলে মিছিলে উত্তাল। ৬ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। তার বেতার ভাষণে তখনকার পূর্ব বাংলার আন্দোলনরত জনগণকে তিনি ‘দুষ্কৃতিকারী’ আখ্যা দেন।

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি সভা হয়। কয়েক ঘণ্টার সেই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানান।

হরতাল পালনে ষষ্ঠ দিনের মত সর্বস্তরের জনতা নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে আগে বেতন দেওয়া হয়নি, সেসব অফিস খোলা রাখা হয়। বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইট ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যান। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হন।

রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর গুলি চলে, সেখানে অন্তত ১ জন নিহত হন। খুলনায় সংঘর্ষ আর গুলিতে ১৮ জন নিহত, ৮৬ জন আহত হন। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সকল বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি জানান।

লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে।’

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য শেখ মুজিবকে দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জানান, ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে।

আর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেবেন, তা জানতে বাংলার মুক্তিকামী জনতা তখন অধীর অপেক্ষায়।

(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইট, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ‘৭১ এর দশমাস’)।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭