এডিটর’স মাইন্ড

অর্থ পাচারকারীরা একালের যুদ্ধাপরাধী


প্রকাশ: 06/03/2023


Thumbnail

মার্চ মাস বাঙালির আবেগের মাস। স্বাধীনতার মাস। ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তি ও স্বাধীনতা বলতে জাতির পিতা রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলেছিলেন। ৭ মার্চ জাতির পিতার দেখানো পথেই বাঙালি এগিয়ে যায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে চালায় নির্মম, নৃশংসতম বর্বরতা। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হওয়ার পরও মাথা নোয়ায়নি বীর বাঙালি। জাতির পিতার নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আমরা পাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। রক্তে রঞ্জিত পতাকা, মানচিত্র। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই জাতির পিতার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। অর্থনৈতিক মুক্তি। একটি স্বনির্ভর স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। যেখানে সব মানুষ তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে। বিশ্বে বাঁচবে সম্মানের সঙ্গে। মাথা উঁচু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সে পথেই গড়ার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্টের জঘন্যতম ঘটনা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ঝাপসা হয়ে যায় অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। বাংলাদেশ একটা পর মুখাপেক্ষী, পরনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবেই চিহ্নিত হতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা বলেছিল, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’; কিংবা যেসব অর্থনীতিবিদ এ দেশ সম্পর্কে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে দারিদ্র্যের মডেল’—তাদের ভবিষ্যদ্বাণী যেন সত্য প্রমাণিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ হারে না। বাঙালি বিজয়ী জাতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই শেখ হাসিনা শুরু করেন জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার সংগ্রাম। শুরু করেন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের দ্বিতীয় যুদ্ধ। ২০০৯ সাল থেকে এই যুদ্ধে দৃঢ়ভাবে লড়াই করছে বাংলাদেশ। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। এই যুদ্ধ একটু অন্যরকম যুদ্ধ। শেখ হাসিনা এ যুদ্ধের সেনাপতি। প্রবাসে থাকা রেমিট্যান্স পাঠানো কর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, সোনার ফসল ফলানোর কৃষক, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তারা হলেন এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা। যে ভাই বা বোনটি প্রবাসে কঠিন পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, তিনি এ যুদ্ধে সাহসী সৈনিক। গার্মেন্টসে যে বোনের নিপুণ বুননে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তিনি এই যুদ্ধের যোদ্ধা। যাদের পরিশ্রমে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, তারাই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। আর এ যুদ্ধটা অনেকটাই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতোই।

’৭১-এ যেমন রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ক্রীতদাস রাখার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল এ দেশের রাজাকার, আলবদর এবং যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী। এ যুদ্ধেও বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিপক্ষ আছে। এরাও ’৭১-এর মতো বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তির প্রতিপক্ষ। এরা বাংলাদেশকে পরমুখাপেক্ষী রাখতে চায়। পরনির্ভর রাখতে চায়। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে পঙ্গু রাখতে চায়। গার্মেন্টসকর্মী, রেমিট্যান্সযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীরা যদি একালের মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে তখনকার রাজাকার, আলশামস, আলবদর আর যুদ্ধাপরাধী কারা?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের উন্নয়নের চিত্রটা একটু বিশদ বিশ্লেষণ করতে হবে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের বিপ্লব হয়েছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল—বাংলাদেশের উন্নয়নের একেকটি স্বারক চিহ্ন। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন কেন? কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, প্রবৃদ্ধির হার সবকিছুই ঈর্ষণীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে যে শঙ্কা, তা থেকেও আমরা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারতাম। তিনটি কারণে আমাদের অর্থনীতি এখন সংকটে। তিন ত্রুটির জন্য এখনো আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি বা জাতির পিতার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার দ্বিতীয় ধাপ অর্জন করতে পারিনি। এ তিন ব্যাধি হলো—দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপি। এ তিনটি ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারলেই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। দুর্নীতি যে আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম শত্রু তা চিহ্নিত করেন জাতির পিতা। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পিরোজপুর শহরের গোপালকৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কোনো অফিস-আদালতে দুর্নীতি হলে এবং আপনাদের নিকট ঘুষ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তিন পয়সার একটি পোস্ট কার্ডে লিখে আমাকে জানাবেন। আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যাতে দুর্নীতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ নীতি এবং আদর্শে অটল বঙ্গবন্ধুকন্যা। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা এখনো সক্রিয়। দুর্নীতিবাজরা একালের রাজাকার। প্রশাসনে, রাজনীতির মধ্যে দুর্নীতিবাজরা শক্ত শেকড় দৃশ্যমান। এ শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা সম্ভব নয়।

একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে, বাংলাদেশ থেকে যদি বিপুল অর্থ পাচার না হতো তাহলে আমরা অর্থনীতিতে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকতাম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সুইস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ২০২১ সালের প্রতিবেদন বলছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে জমার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকেই পাচার হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য দেশে অর্থ পাচারের হিসাব যোগ করলে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারা বিদেশে অর্থ পাচার করে আমরা সবাই জানি। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারিতে এরকম ৪৩ জন অর্থ পাচারকারীর নাম এসেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ডলার সংকটের মুখে সরকার অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ ছাড় দেয়। পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করাও ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। অর্থ পাচারকারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা একালের যুদ্ধাপরাধী। কারণ, আমরা যতই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি, যতই উপার্জন করি না কেন, অর্থ যদি পাচার হয়ে যায়, তাহলে কিছুতেই আমরা আমাদের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারব না। আমরা স্বাবলম্বী হতে পারব না। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি থেকেই যাবে।

আমাদের মুক্তির সংগ্রামের তৃতীয় শত্রু হলো ঋণখেলাপি। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সম্প্রতি এক ভাষণে ঋণখেলাপিদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কেউ কেউ ইচ্ছে করেই ঋণখেলাপি হয়। ব্যাংক থেকে টাকা নেয় পরিশোধ না করার জন্য।’ তার এ বক্তব্য যে কতটা নির্মম বাস্তবতা, তা বোঝা যায় ব্যাংকের ঋণখেলাপির হিসাব থেকেই। গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। গত তিন মাসে শুধু খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে কথাই হয়েছে শুধু। অর্থ উদ্ধারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খেলাপি ঋণ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ভয়ংকর রোগ। যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার জন্যই ঋণ নেন, তারা একালের রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী। এদের জন্যই মুক্তির সংগ্রামে এখনো আমরা বিজয়ী হতে পারছি না।

মার্চ মাস আমাদের দ্রোহের মাস। সংকল্পের মাস। নতুন মুক্তিযুদ্ধে তাই এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে। নব্য রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের পরাজিত না করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারব না। স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কিংবা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কোনোটাই অর্জন করা যাবে না।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭