ইনসাইড বাংলাদেশ

বিএনপির দুর্নীতির ফল বিস্ফোরণ, ২০ বছর পর ভোগ করছে রাজধানীবাসী


প্রকাশ: 08/03/2023


Thumbnail

রাজধানীতে পর পর দুটি বিষ্ফোরণের ঘটনায় মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আমরা কেউই নিরাপদ নয়। যে কোনো সময়ে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন রাজধানীবাসী। অন্যদিকে এসব ঘটনা শুধুই দুর্ঘটনা নয় বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ মনে করছেন এসব ঘটনা পরিকল্পিত এবং নাশকতামূলক ঘটনা। অন্যদিকে প্রকৌশলীরা বলছেন, ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকার কারণে এসব দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। ভবনগুলো নির্মাণের সময় নকশা বা নির্মাণ কাজ পরিদর্শন না করেই ভবনগুলোর বাণিজ্যিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

ভবনগুলো নির্মাণের সময়ে সরকার ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। তৎকালীন বিএনপি সরকার দুর্নীতি করে এই ভবনগুলোর নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্রগুলো বলছে, ভবনগুলো বেশ পুরোনো। ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগের ভবন এগুলো। এ ভবনগুলো অনুমোদনের সময় সরকারের ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। পরে ২০০১ সালের দিকে ক্ষমতায় এসে বিএনপি রাজউকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদাকে। সে সময়ে সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মির্জা আব্বাস। সে সময়ে ভবনগুলোর বাণিজ্যিক করার নকশা অনুমোদন এবং পর্যবেক্ষণ যথাযথ হয়নি। ফলে ২০ বছর পরে বিএনপির এই দুর্নীতির ফল ভোগ করছে রাজধানীবাসী।            

গতকাল মঙ্গলবার (৭ মার্চ) গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে ঘটনা গঠেছে। এ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনের নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ২০০ জনের বেশি মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি মানুষকে হাসপাতালে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ২০ জন এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

বেজমেন্টে জমে থাকা গ্যাস থেকে মঙ্গলবার (৭ মার্চ) গুলিস্তানের ভবনটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে র‍্যাব। বুধবার (৮ মার্চ) র‍্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের ডেপুটি ডিরেক্টর মেজর মশিউর রহমান এ কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি ভবনের বেজমেন্ট থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। এটা কোনো সাধারণ বিস্ফোরণ নয়। এটা বেজমেন্টে জমে থাকা গ্যাস থেকে হতে পারে। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে বিস্ফোরণ এসি থেকে হয়নি।

এছাড়াও এদিন বুধবার (৮মার্চ) সিদ্দিকবাজারের ওই ভবনের নকশার মধ্যে অনেককিছু সঠিকভাবে করা হয়নি বলে মন্তব্য করেন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান। মেজর মশিউর রহমান বলেন, ‘মেটারিয়াল অনেক কিছুই সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। গ্যাসের লাইন বৈধ ছিল কি না, এ ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আমরা মন্তব্য করতে চাই না।’

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভবনের ভেতর ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে তিতাস গ্যাসের সহায়তায় পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে আমরা গ্যাসের উপস্থিতি পাইনি। ভবনে গ্যাসের সংযোগ আছে। কিন্তু কোনো লিকেজ বের করতে আমরা পারিনি। এক্সপ্লোশন বেজমেন্টে হয়েছে, উপরের কোনো ফ্লোর থেকে হয়নি। এসি কিংবা ইলেক্ট্রনিকস ডিভাইস থেকেও এ বিস্ফোরণ হয়নি। বেজমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোর অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের বিম ও কলাম অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা ধারণা করছি, গ্যাস লাইনের এক্সপ্লোশন থেকে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আবার অন্য কোনো এক্সক্লুসিভ মেটারিয়াল থেকেও হয়ে থাকতে পারে। আমরা কিছু স্যাম্পল পেয়েছি, যা পরীক্ষা করছি।’

তিনি বলেন, ‘ভবনটিতে গ্যাসের সংযোগ আছে। কিন্তু কোনো লিকেজ বের করতে পারিনি। যেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে, ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সে পর্যন্ত আমরা যেতে পারিনি। আমরা আরও চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

এর আগে রোববার (৬ মার্চ) রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবন শিরিন ম্যানশনের ৩য় তলায়  বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১৪ জন। সায়েন্সল্যাবে বিস্ফোরণের ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ওই দিন বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনীর কেমিক্যাল ডিজাস্টার রেসপন্স টিম (সিডিআরটি) ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের দুটি পৃথক দল। তবে সেখানে বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানায় সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল। রোববার (৫ মার্চ) বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য জানান বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান কমান্ডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী।

ওই দিন মেজর কায়সার বারী বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে ঘটনাস্থলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর আমরা মনে করছি, এ বিস্ফোরণ বিস্ফোরক দ্রব্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ডিজাস্টার রেসপন্স টিমের ভাষ্যমতে, দুটি ভবনের কোনটিতেই নাশকতামূলক কোনো কর্মকাণ্ড ঘটেনি। মূলত ভবনগুলোতে জমে থাকা গ্যাসের কারণে এ বিস্ফোরণগুলো হতে পারে। এছাড়াও ভবনগুলো ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলেও মন্তব্য করেছেন দুর্ঘটনা পরদির্শনে আসা বিভিন্ন বাহিনী। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠেছে, ভবনগুলোতে গ্যাস জমলো কিভাবে? কিভাবে এই বিস্ফোরণগুলো হলো? ভবন নির্মাণের নকশা মেনে যদি ভবন নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তবে সেখানে বিস্ফোণের ঘটনা ঘটার কথা নয়।       

সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মির্জা আব্বাস। সে সময়ে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রকৌশলী মো.নুরুল হুদা। বিভিন্ন কারণে প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা সে সময় বিতর্কিত হয়েছেন। রাজধানীতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের বাণিজ্যিক ভবনের নকশা মানা হয়নি। এর আগে বিএনপি সরকারের সময়ে ভবনগুলো নির্মাণের নিয়মনীতিও মানা হয়নি। ২০০১ সালের পরে মির্জা আব্বাস ও প্রকোশলী নুরুল হুদার সময়ে কোনো রকম ভবন নির্মাণ বিধিমালা এবং নকশা না মেনে ঢালাওভাবে বেশ কিছু ভবন নির্মাণ ও ভবন বাণিজ্যিক করনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সময়ে ২০ বছর পর এই ত্রুটিপূর্ণ ভবনগুলোতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এবং জীবন বিসর্জন দিয়ে সে ফল ভোগ করছে রাজধানীবাসী। এ হচ্ছে বিএনপির দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতির ফল। বিএনপির সময়ে এ ভবনগুলোর নকশা পর্যবেক্ষণ না করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং পরে বানিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে এখন দুর্ঘটনার পর বোঝা যাচ্ছে, ভবনগুলো ত্রুটিপূর্ণ ছিল।      

রাজধানীর সিদ্দিকবাজার  ও সায়েন্সরল্যাবের বিস্ফোরণের ঘটনা দুটির বিষয় নিয়ে প্রকৌশলীরা বলছেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি আলাদা হলেও ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের ভবন, সিদ্দিক বাজারের ভবন ও ২০২১ সালে মগবাজারের দুর্ঘটনাগুলো একই প্রকৃতির। যেখানে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় কনফাইন্ড স্পেস এক্সপ্লোশন। বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বাতাসের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ মিক্সচার তৈরি করলে এ ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছিল ভবনের তিনতলায়। ফলে চাপে দেয়াল ভেঙে সহজে প্রশমিত হয়েছে। সিদ্দিক বাজারের বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল ভবনের বেজমেন্টে হওয়ায় নিচে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যাতে ভবনের সিঁড়িঘর, বেজমেন্ট ছাদ ভেঙে ওপরে এসে পাশের দেয়াল ও ওপর তলা কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভবনের কলামগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে পুরো ভবন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

প্রকৌশলীরা আরও বলছেন, বর্তমানে ভবনে যেহেতু গ্যাসের লাইন, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহৃত হয়, তাই এগুলোর ছিদ্র থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। এ ছাড়া বাসাবাড়ি অন্য যেসব ইউটিলিটি লাইন, অব্যবহৃত পাইপলাইন, স্যুয়ারেজ লাইন থাকে, এগুলোর মাধ্যমে দাহ্য গ্যাস ভবনের বদ্ধ স্থানগুলোতে জমা হয়ে এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তবে ভবন নির্মাণের সময়ে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে নকশা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। যদি ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত নকশা মেনে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম থাকে।   



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭