ইনসাইড আর্টিকেল

‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’: মুজিবময় পূর্ব পাকিস্তানের বদলে যাওয়া দৃশ্যপট- ৯ মার্চ ১৯৭১


প্রকাশ: 09/03/2023


Thumbnail

৯ মার্চ ১৯৭১। একদিন আগে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুরো দৃশ্যপট বদলে যায়। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠে মুজিবময় বাংলা। একে একে সরকারি, আধা সরকারি, বে-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে। সভা, সমাবেশ ও বিবৃতিতের মাধ্যম সংগঠনের নেতারা সাফ জানিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গৃহীত সকল কর্মসূচি ও সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু আহূত অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টম দিন ৯ মার্চ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। যানবাহন, জরুরি সার্ভিস ও ব্যাংক ছাড়া হাইকোর্ট, জজ কোর্ট, আধা সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। যানবাহন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষ, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা কালো ব্যাজ ধারণ করেন। স্টেট ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো বন্ধ রাখে। দেশের সর্বত্র মিছিল-মিটিং অব্যাহত থাকে।

মার্চ মাস বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাংলাদেশের জন্ম হয় এই উত্তাল মার্চেই। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র ৯ম পর্বে থাকছে ৯ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।

একাত্তরের উত্তাল মার্চের নবম দিন সারাদেশ ছিল মিছিলে মিছিলে উত্তাল। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চূড়ান্ত মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তার ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারাদেশে সব সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা আদালতসহ সবখানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, শুধু সেসব অফিস চালু থাকে।

এদিন আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু আহূত অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টম দিন ৯ মার্চ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। যানবাহন, জরুরি সার্ভিস ও ব্যাংক ছাড়া হাইকোর্ট, জজ কোর্ট, আধা সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। যানবাহন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষ, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা কালো ব্যাজ ধারণ করেন। স্টেট ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো বন্ধ রাখে। দেশের সর্বত্র মিছিল-মিটিং অব্যাহত থাকে। প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন ভাসানী। বিকেলে পল্টন ময়দানের ওই জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে তিনি বলেন, ‘ইয়াহিয়া সাহেব, অনেক হয়েছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নাও।’

ভাসানী সেদিন বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমত আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনো কিছু না করা হলে আমি মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন শুরু করব।’

পল্টন ময়দানে আয়োজিত সমাবেশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ২৫ মার্চের পূর্বে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অন্যথায় ১৯৫২ সালের মতোই আমি ও শেখ মুজিব ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করব। ইয়াহিয়া খান, তোমার যদি পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচ কোটি মানুষের জন্য দরদ থাকে তাহলে তুমি পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা কর। এতে করে দুই পাকিস্তানে ভালবাসা থাকবে, বন্ধুত্ব থাকবে। কিন্তু এক পাকিস্তান আর থাকবে না, থাকবে না, থাকবে না!’

ভাসানী বলেন, ‘আমি অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করি না। অহিংসার কথা বাদ দাও, এটা অবাস্তব। আমার নবী (সা.) বলতেন, প্রথমে আক্রমণ করো না। কিন্তু কেউ যদি আক্রমণ করে তার তেরটা কেন চৌদ্দটা বাজিয়ে দাও।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ায় তাদেরকে মোবারকবাদ জানান ভাসানী।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তখন পুরো পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হচ্ছিল। তার নির্দেশ মেনেই ঢাকা হাইকোর্টের কোনো বিচারক ‘বাংলার কসাই’ আখ্যা পাওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর হিসাবে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন। এর আগে ৬ মার্চ গভীর রাতে ইসলামাবাদ টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসক নিয়োগ করে। এ নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। ওই দিন তিনি ঢাকায় আসেন। ৯ মার্চ তার গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা ছিল। সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ঘোষণা আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ এর ছাত্রসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ছাত্রলীগ শেখ মুজিবের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানান। সকালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বাঙালি কর্মচারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘণ্টার কারফিউ জারি করে।

এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উসকানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

চট্টগ্রামে অবাঙালিরা রেলওয়ে কলোনি এবং এ কে খান রোডে সংঘর্ষে জড়ায় দুপুরের দিকে। বিকালে হালিশহর থেকে দেওয়ানহাট হয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে অবাঙালিরা। অন্যদিকে চট্টেশ্বরী রোডে ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’ এর অফিসে গণসংগীতের মহড়া শুরু হয়।

জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট এদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কর্মকর্তা ও তাদের  পরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ঢাকায় উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়।

(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ‘৭১ এর দশমাস’)।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭