ইনসাইড আর্টিকেল

‘মার্চের উত্তাল দিনগুলো’: সর্বস্তরে অসহযোগ আন্দোলন - ১১ মার্চ ১৯৭১


প্রকাশ: 12/03/2023


Thumbnail

একাত্তরের উত্তাল মার্চের একাদশতম দিনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকারের সাথে সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে শরিক হয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারী অফিস বর্জন করেন। একাত্তরের এই দিনে সচিবালয়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সকল সরকারি ও আধাসরকারি ভবন ও বাসগৃহের শীর্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে।

মার্চ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের অসহযোগ আন্দোলনের মাস। এই মাসেই বীর বাঙালি স্বাধীনতার নেশায় প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধা না করে মহান মুক্তিযদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র একাদশ পর্বে থাকছে ১১ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ। 

ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ববাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম. খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে পৃথক পৃথক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন।

সংগ্রামী জনতা সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪নং সামরিক আদেশ জারি করে নির্দেশ দেন যে, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পতির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের শামিল বলে গণ্য হবে, যা সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।

টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি বাঙালির নেতা। নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই এক সাথে হয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন রকম বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান।’

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দশ দিনের ঘটনা প্রবাহে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বুঝতে পারছিলেন- অবস্থা বেগতিক। ১১ মার্চ বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি তারবার্তা পাঠিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি সমঝোতার আহ্বান জানান।

ওই তার বার্তায় ভুট্টো বলেন, ‘উদ্ভূত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা আজ বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করতেই হবে।’

তবে বাঙালির অধিকার আদায় না করে পাকিস্তানকে এক রাখা যে সম্ভব নয়, সে কথা এদিন আবারও মনে করিয়ে দেন গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান।

করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন বাংলার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী এবং সচিবরা তার নির্দেশ পালন করছেন। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সর্বস্তরের মানুষ তখন পাকিস্তানি শাসকদের সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। হাই কোর্টের বিচারক এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সারা বাংলার সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করছেন।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার কাছে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সমরসজ্জায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গণ অসহযোগ আন্দোলন এক নজিরবিহীন তুঙ্গে পৌঁছেছে জনগণের সংগ্রাম সফল করার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত সকলকে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলবে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক সভায় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানানো হয়। গণআন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের একদিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

গণহত্যার প্রতিবাদে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর পাকিস্তান সরকারের এক চিত্র-প্রদর্শনীতে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এ দেশের চিত্রশিল্পীদেরও সেখানে যোগদানে বিরত থাকার আহ্বান জানান। জনতার বাধার মুখে পড়ে সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহ। সিলেটে রেশন নেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেওয়া হয়। যশোরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

কর্মী না থাকায় দেশের সব আদালত ১১ মার্চ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। কুমিল্লা কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে এদিন পুলিশের গুলিতে পাঁচ কয়েদি নিহত হয়। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ২৪ কয়েদি পালিয়ে যায়, গুলিতে নিহত হয় দুজন।

১১ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক ‘আঁতে ঘা’ শিরোনামে একটি প্রদিবেদন ছাপে। সেখানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে করাচী শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি আহমদ আবদুল্লাহর পাঠানো তারবার্তার বরাতে লেখা হয়, পূর্ব বাংলা থেকে আর্থিক লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা আর্থিক দুর্দশার সম্মুখীন। তিনি সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ‘৭১ এর দশমাস’, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর)। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭