ইনসাইড আর্টিকেল

‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’: ঢাকায় আসেন ইয়াহিয়া - ১৫ মার্চ ১৯৭১


প্রকাশ: 15/03/2023


Thumbnail

 ১৯৭১-এর ১৫ মার্চ ছিল সোমবার। এই দিন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের অষ্টম দিবস। এই দিনটিতেও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও সরকারি, আধা-সরকারি অফিস-আদালত বর্জনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল। এছাড়া আন্দোলনে নিহত বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে শোক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের আশা-আকাক্ষাকে তোয়াক্কা না করে এক তরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কালো পতাকা উড়তে থাকে।

মার্চ মাস বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের অসহযোগ আন্দোলনের মাস। এই মাসেই বীর বাঙালি স্বাধীনতার নেশায় মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র পঞ্চদশ পর্বে থাকছে ১৫ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ। 

১৩ মার্চ জারিকৃত ১১৫ নং সামরিক আইন আদেশে সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করা হলেও কোন বিভাগের কোন সরকারি কর্মচারী এদিন কাজে যোগ দেননি। বরং তারা সামরিক আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং ঢাকার নাখালপাড়ায় এক প্রতিবাদ সভা করে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচীর প্রতি পুনর্বার একাত্মতা ঘোষণা করেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এমএলআর অর্থাৎ মার্শাল ল’ রেগুলেশনস অমান্য করে সামরিক বিভাগের অধীনে অর্ডিন্যান্স ডিপোর প্রায় ১১ হাজার কর্মচারীর কেউই এইদিন কাজে যোগদান করেননি। সরকারী কর্মচারীগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এএলআর অর্থাৎ আওয়ামী লীগ রেগুলেশনস অনুযায়ী তাদের কর্মসূচী পালন করে। বস্তুত বাংলাদেশ তখন এমএলআর-এর বিপরীতে এএলআর দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে।

এ সময় অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানে আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নর ‘বাংলার কসাই’খ্যাত লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাদা রঙ্গের গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে যান। ১৬ মার্চ শুরু হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া খানের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক। 

সমঝোতার নাটক করতে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আসলেও মুক্তিকামী বাঙালি তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। দেশবাসীকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করার প্রতিবাদস্বরূপ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের খেতাব বর্জন করেন। শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ খেতাব বর্জনের বিষয়টি ব্যাপক সাড়া ফেলে।

বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশে কেবল বাংলার সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কোন নির্দেশ জারি করতে পারেন এবং বাংলার জনসাধারণ কেবলমাত্র সেই বিধিই মেনে চলবে। কেননা বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির নির্বাচিত নেতা।’

জনসভা শেষে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলটি কাকরাইল, বেইলি রোড হয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে। ইয়াহিয়া খান তখন ওই ভবনেই অবস্থান করছিলেন। ভবনের সামনে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য উপস্থিতি ছিল। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়।

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ঢাকার চেকপোস্টগুলো তুলে নেয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টিভিশিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান করেন।

চিকিৎসকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সভা থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানান। 

তোপখানা রোডে বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নারী সমাবেশ থেকেও বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সকল কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। এদিকে ঢাকা নগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া স্বেচ্ছাসেবকরা গোলযোগ তৈরির চেষ্টা করলে এদিন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক বিবৃতিতে বলেন, ‘কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পোশাক ও টুপি নকল করে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এসব দুষ্কৃতকারিদেরকে ধরে আওয়ামী লীগ অফিসে প্রেরণ করতে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সব শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জনের আহ্বান জানায়। দেশবাসী উৎসাহ ও উদ্দীপনা পেয়ে নিজেদের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। এ দিনে ঢাকা শহরে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সবার সভা-সমাবেশ অব্যাহত থাকে।

বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি টেলিভিশন নাট্যশিল্পী সংসদ এদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তাদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মজিদ। বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাসান ইমাম, ফরিদ আলী, শওকত আকবর, আলতাফ হোসেন, রওশন জামিল, আলেয়া ফেরদৌস প্রমুখ।

একইদিনে ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরেও সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং চলতে থাকে। এদিনে নেত্রকোনায় স্ইুপার ও ঝাড়ুদাররা ঝাড়ু, দা, লাঠি ও কোদাল নিয়ে মিছিল বের করে। বগুড়া, খুলনা, রংপুর, লাকসাম, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার সপক্ষে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের বিশাল সমাবেশ। এতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল ফজল। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাংবাদিক নূর ইসলাম প্রমুখ। 

সময় তখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে অনিবার্য পরিণতির দিকে; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে চলছে পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন। একাত্তরের ১৫ মার্চেও ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। সরকারি-বেসরকারি ভবনে এবং যানবাহনে উড়ছিল কালো পতাকা।

এদিন ১৪ মার্চ করাচির সভায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর দুই দলের অধীনে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানে জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান, ন্যাপ (ওয়ালী), মুসলীম লীগ (কাউন্সিল) এবং পিডিপির নেতারা এক বিবৃতিতে ভুট্টোর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্যে তাকেই দায়ী করেন।

রাতে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের এই আহ্বানে জনগণের নিরঙ্কুশ সাড়া পাওয়া গেছে।’

খুলনার হাদীস পার্কে এক সমাবেশে জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বলেন, ‘বাংলার প্রতিটি মানুষ আজ বঙ্গবন্ধুর পেছনে একতাবদ্ধ। রেডিও, টিভি, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি আজ আওয়ামী লীগ প্রধানের আজ্ঞাবাহী।’

(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ‘৭১ এর দশমাস’)।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭